সিলেটে করোনা: আতঙ্কে প্রায় ফাঁকা শহর, সড়ক

একে অপরের শরীর ঘেঁষে চলাচল করছে শত শত মানুষ, আর রাস্তায় যানবাহনের দীর্ঘ সারি—সিলেটের ব্যস্ততম এলাকা বন্দরবাজারের চিরচেনা দৃশ্য এটি। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার ছিল বিপরীত চিত্র। রাস্তায় দেখা গেছে হাতে গোনা কিছু মানুষ। যানবাহন চলাচলও ছিল সীমিত। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন ছিল আরও ফাঁকা।

শুধু বন্দরবাজারই নয়, নগরের ২৭টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাটে মানুষের উপস্থিতি একেবারেই কমে গেছে। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে মানুষ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছে না। তাই দিনের বেলাও পুরো এলাকা ‘নিরাই’ (ফাঁকা) থাকে।

গত বৃহস্পতিবার সকাল, দুপুর ও বিকেলে তিন দফা সরেজমিনে বন্দরবাজারে দেখা গেছে, ওই এলাকায় ব্যাংক, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রধান ডাকঘর, আদালত, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আর বিপণিবিতানগুলো খোলা ছিল। তবে সবখানেই মানুষের উপস্থিতি অন্যান্য দিনের চেয়ে ছিল অনেক কম।

গতকাল শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় ওই এলাকাসহ নগরের ২৭টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাটে মানুষের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। ফুটপাত ছাড়া ছোট-বড় বিপণিবিতানগুলো ছিল বন্ধ। তবে মসজিদগুলোতে বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। শহরের প্রায় প্রতিটি মসজিদেই ছিল মুসল্লিদের ভিড়।

নগরের মদিনা মার্কেট এলাকার আল-মদিনা জামে মসজিদ ও পনিটুলা এলাকার বায়তুল মামুর জামেয়া মসজিদে দেখা গেছে, মসজিদের ভেতরের পাশাপাশি বাইরের রাস্তায় জায়নামাজ বিছিয়ে জুমার নামাজ আদায় করছেন মুসল্লিরা। বায়তুল মামুর জামেয়া মসজিদে নামাজ শেষে সমাজকর্মী এম ইয়াহিয়া বেগ মনোয়ার জানান, ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতি থেকেই সব সময়ের রেওয়াজ অনুযায়ী মানুষজন মসজিদে নামাজ পড়তে এসেছেন।

বায়তুল মামুর জামেয়া মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা জামিল আহমদ জানান, অন্যান্য জুমাবারের মতোই গতকাল মসজিদে মুসল্লিদের উপস্থিতি ছিল। গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে নগরের শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারে দেখা গেছে, প্রায় দেড় থেকে দুই শ নারী-পুরুষ মাজার জিয়ারত করছেন। অন্য সময় শুক্রবারে হাজারো মানুষ মাজারে থাকেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।

সিলেটর কদমতলী বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করে। কিন্তু গত তিন দিনে এই যাত্রীদের চলাচল অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে চারটার দিকে ওই টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি বাসই কমবেশি অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে।

হবিগঞ্জগামী একটি যাত্রীবাহী বাসে উঠে দেখা গেছে, ২৩ জন যাত্রী নিজেদের সিটে বসে আছেন। এর মধ্যে ১২ জনের মুখে মাস্ক আছে। একজন যাত্রী একটু পরপর জীবাণুনাশক ‘হেক্সিসল’ দিয়ে হাত পরিষ্কার করছিলেন। ফরিদ উদ্দিন নামের এক যাত্রী বলেন, ‘আমি সিলেটে একটি দোকানে বিক্রয় ব্যবস্থাপকের কাজ করি। করোনার ভয়ে মালিকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। কিন্তু এখন বাসে চড়তেও ভয় হচ্ছে।’

হবিগঞ্জ মোটর মালিক গ্রুপের কাউন্টারে বসে গত বৃহস্পতিবার বাসের টিকিট বিক্রি করছিলেন ব্যবস্থাপক কল্যাণ কর। তিনি জানান, তাঁদের ব্যবস্থাপনায় মৌলভীবাজারে ৪৭টি, হবিগঞ্জে ৩৭টি ও মাধবপুরে ১৩টি বাস চলাচল করে। এসব রুটে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার যাত্রী চলাচল করত। এখন সেটা অর্ধেকে নেমে এসেছে। যাত্রীরা সিলেট থেকে যাচ্ছে, তবে সিলেটে কমই এখন আসছে।

গত বৃহস্পতিবার বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে সিলেট রেলস্টেশনে কাউন্টারের সামনে তিনজন যাত্রীকে টিকিট কিনতে দেখা গেছে। মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরা রেলস্টেশনের বুকিং সহকারী জহরলাল দাস বলেন, করোনা-আতঙ্কে যাত্রীদের সংখ্যা কমে গেছে। অন্যান্য দিন এই সময় যাত্রীদের প্রচণ্ড চাপ থাকত। স্টেশনের কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম জানান, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন রুটে চার হাজার আসন রয়েছে। এর মধ্যে অন্য সময় কমবেশি তিন হাজার টিকিট বিক্রি হতো। এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে।

বাস টার্মিনাল ও রেলস্টেশনে গতকাল শুক্রবারও একই দৃশ্য দেখা গেছে। অন্যদিকে প্রতি শুক্রবার যেখানে নগরের চৌহাট্টা এলাকার মাইক্রোবাসস্ট্যান্ডে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যেত না, গতকাল সেই স্ট্যান্ডে চালকদের অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে। শহরতলির লাক্কাতুরা ও মালনী ছড়া চা-বাগানসহ বিভিন্ন দর্শনীয় পর্যটনকেন্দ্রেও লোকসমাগম ছিল না। শহরের রাস্তাঘাট ছিল প্রায় মানুষশূন্য।

সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন আয়োজকেরা। সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি মিশফাক আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘করোনার বিস্তার ঠেকাতে আমরা সব সংগঠনকে জানিয়ে দিয়েছি, এই সময়টাতে কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না।’ 

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সিলেটের সভাপতি আজিজ আহমদ সেলিম জানিয়েছেন, সিলেটের টিআইবি ও সনাক কার্যালয় গত বৃহস্পতিবার থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে। কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাসা থেকেই এখন অফিসের যাবতীয় কাজ করবেন।

সিলেটের সিভিল সার্জন প্রেমানন্দ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, সবাইকে সচেতন হয়ে চলাফেরা করতে হবে। জনসমাগম অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে। বারবার সাবানপানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন ঘরের বাইরে না বেরোন। করোনার লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবেন।