করোনার কারণে বাজারে হুড়োহুড়ি, মূল্যবৃদ্ধি

করোনাভাইরাসের প্রভাবে পণ্যসংকট হবে—এমন আতঙ্কে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারে ক্রেতারা কেনাকাটা করতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। এই সুযোগে কিছু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে কিছু ব্যবসায়ী খাদ্য মজুত করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। বেশি দাম রাখায় কোনো কোনো ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়েছে।

প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক বরিশাল, পটুয়াখালী, গৌরনদী, সিরাজগঞ্জ, আদমদীঘি, পাবনা ও গুরুদাসপুর প্রতিনিধি বিভিন্ন বাজার ঘুরে এসব তথ্য জানিয়েছেন। অনেক বাজারে পণ্যের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে। ৪০ টাকা দরের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়।

বরিশাল নগরের বিভিন্ন বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, হ্যান্ডওয়াশ ও স্যানিটাইজার কেনার হিড়িকের পর এবার শুরু হয়েছে বিপুল পরিমাণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাকাটা। এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। খুচরা বাজারে চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৬ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত। আর পেঁয়াজে বেড়েছে খুচরা বাজারে ৪০ টাকা পর্যন্ত।

চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, মোকামেও চালের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মিলের মালিকেরা ধানের সংকট দেখিয়ে চাল সরবরাহ করতে পারছেন না। বোরো না ওঠা পর্যন্ত চালের বাজার স্বাভাবিক হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছেন না।

বাজারের দোকানগুলোয় ক্রেতাদের ভিড়ে ঠাসা। কেউ দরদামের তোয়াক্কা করছেন না। সবাই চাইছেন বাড়তি চাল, ডাল, নিত্যপণ্য। দাম যা–ই হোক, তাতে কিছু যায়–আসে না। পরিস্থিতি এমন যেন মহাদুর্যোগকে সামনে রেখে সবাই ব্যস্ত আগামী কয়েক মাসের খাবার কিনে মজুত করতে। দোকানিরাও গলদঘর্ম। দোকানগুলোয় কদিন আগেও এক কেজি আলুর দাম ছিল ছিল ১৫ থেকে ১৮ টাকা। গত বৃহস্পতিবার তা এক লাফে ২০ টাকা হয়ে গেছে। দর-কষাকষির কোনো সুযোগ নেই।

একটি দোকানে দেখা গেল, একজন ক্রেতা আলু–আটার দাম নিয়ে দোকানিকে প্রশ্ন তুলেছেন। দোকানি অনেকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনার না পোষালে মাল রেখে যান। অন্য দোকান থেকে কিনুন।’ পাশের দোকানে আবার অনেক ক্রেতা প্রশ্ন ছাড়াই সেসব পণ্য বেশি দামে কিনে নিচ্ছেন। কিনতে পেরে তাঁদের মুখে স্বস্তিও দেখা গেল।

শাহনাজ বেগম নামের এক গৃহবধূ বলেন, ‘ঘরে মাসিক বাজার-সওদা এখনো শেষ হয়নি। পুরো মাস চলবে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে বাজারে সরবরাহের ঘাটতি হতে পারে এবং দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেতে পারে—এমন আশঙ্কায় অগ্রিম আগামী মাসের বাজার-সওদাও করে রেখেছি। দাম অনেক বাড়তি। সে চিন্তা করার এখন সময় নেই। না খেয়ে তো আর থাকা যাবে না!’

বটতলা বাজারের আকন স্টোরের মালিক মাহতাব হোসেন বলেন, ‘দুদিন ধরে ঘাড় ফেরানোর সময় পাচ্ছি না। ক্রেতাদের ভিড়ে দুপুরের খাবারও খেতে পারছি না। ঈদের আগে যেভাবে বেচাবিক্রির ভিড়ে দম ফেলার সময় পাই না, তেমন হয়েছে।’

বরিশালের জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান গতকাল শুক্রবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ক্রেতাদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। গুজবে কান না দিতে পরামর্শ দিচ্ছি। দেশে চাল বা অন্য সব নিত্যপণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। প্রয়োজনে এ নিয়ে আমরা মাইকিং করব। ইতিমধ্যে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের বেশ কয়েকটি দলকে মাঠে নামিয়েছি। তবে সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে এর ফল পাওয়া অসম্ভব।’

পটুয়াখালীতে বাড়তি কেনাকাটার প্রবণতা দেখা দেওয়ার সুযোগে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রি শুরু করেছেন। এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখতে পটুয়াখালীর প্রশাসন গতকাল শুক্রবার মাঠে নেমেছে। গতকাল শহরের নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ জন ব্যবসায়ী ও ক্রেতাকে ৯৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অন্যদিকে, বাউফল উপজেলায় অতিরিক্ত মূল্যে চাল বিক্রি করার দায়ে চারজন ব্যবসায়ীকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া দুমকি উপজেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশিতে বিক্রি করায় তিন ব্যবসায়ীকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর অভিযোগে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা বাজারে তিন ব্যবসায়ী ও গৌরনদীর উপজেলার টরকী বন্দরের এক ব্যবসায়ীসহ চার ব্যবসায়ীকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সংকট হতে পারে—এমন গুজবে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে সুবিদখালী বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় মুদি দোকানগুলোয় ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় করোনাভাইরাসের কারণে আলু, পেঁয়াজ, রসুন, লবণসহ বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয় করে মজুত রাখার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে উপজেলা সদর সুবিদখালী বন্দরসহ আশপাশের বাসিন্দারা বাজারে ছুটে আসেন। এ সময় ক্রেতারা ৫ কেজি থেকে শুরু করে ১৫-২০ কেজি পর্যন্ত পেঁয়াজ, আলু, রসুনসহ বিভিন্ন সামগ্রী কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। আর এ সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ৪০ টাকা মূল্যের পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৮০ টাকা, ১৫ টাকার আলু ২৫ টাকাসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর ১৫ থেকে ৩০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করেন। বৃহস্পতিবার রাতেই সুবিদখালী বাজারসহ আশপাশের বাজার পেঁয়াজ ও আলুশূন্য হয়ে যায়।

করোনাভাইরাসের আতঙ্ক ঘিরে বগুড়ার আদমদীঘিতে হঠাৎ করে বেড়েছে পেঁয়াজ ও চালের দাম। গতকাল উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ২০ থেকে ২৫ টাকা এবং প্রতি কেজি চাল ধরনভেদে বেড়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা করে।

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার জয়নগর চালের মোকাম ও উপজেলা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের আতঙ্ক ছড়ানোর পর থেকেই সাধারণ ক্রেতারা অতিরিক্ত চাল কিনে ঘরে মজুত করছেন। অনেকে ২০ কেজির স্থলে ২ থেকে ৩ বস্তা পর্যন্ত চাল কিনছেন। এতে মোকামে চালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়ে গেছে। জয়নগর চালের মোকামে স্বর্ণ-৫ জাতের ৩৫ টাকা কেজি দরের চাল ৩৮ টাকা, জিরা জাতের ৪৮ টাকা কেজি দরের চাল ৫১ টাকা, ৫৮ টাকা কেজি দরের কাটারিভোগ ৬০ টাকা এবং ৪৮ টাকা কেজি দরের মিনিকেট ৫১ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। খুচরা বাজারে এই দাম কেজিতে আরও ৩ থেকে ৪ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে আগের তুলনায় খুচরা বাজারে প্রতিকেজি চালের দাম গড়ে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

অন্যদিকে, স্থানীয় বাজারগুলোয় ৪০ থেকে ৪৫ টাকার প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, ৭০ থেকে ৮০ টাকার রসুন ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, ১০০ থেকে ১২০ টাকার আদা ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা এবং ১৮ থেকে ২০ টাকার আলু ২৫ থেকে ২৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

নাটোরের গুরুদাসপুরে জাতভেদে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে গত বৃহস্পতিবার রাতে ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। সভায় ব্যবসায়ীরা পণ্যদ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি।

করোনাভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় চাল, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বেশি দামে পণ্য বিক্রির অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালত এক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেছেন।