প্রয়োজনের চেয়ে ৫ গুণ বেশি চাল কিনে দাম বাড়াচ্ছেন ক্রেতারাই

শুক্রবার। দুপুর ১২টা। যাত্রাবাড়ীর বরিশাল রাইস এজেন্সিতে চাল কিনতে আসেন ইসরাফিল। 

ক্রেতা ইসরাফিল চাল বিক্রেতাকে বললেন, ‘ভাই, মিনিকেট চলের বস্তা কত?’
‘২৭৫০ টাকা।’
‘বলেন কী!’
‘যে মিনিকেট চালের বস্তা গত সপ্তাহে ছিল ২৩০০ টাকা, সেই চালের বস্তা এখন ২৭৫০ টাকা।’
ইসরাফিলের কথা শুনে চাল বিক্রেতা ক্ষিপ্ত হলেন।
বললেন, ‘ভালো লাগলে কিনবেন, না লাগলে কিনবেন না? আমি তো আপনাকে চাল কেনার জন্য জোর করছি না। যে মানুষের দরকার এক বস্তা চাল, সেই মানুষ কিনেছেন পাঁচ বস্তা চাল। চার-পাঁচ দিন ধরে ক্রেতাদের পাগলামির কারণেই তো চালের দাম হু হু করে বাড়ছে।’

চাল না কিনে বরিশাল রাইস এজেন্সির সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন ইসরাফিল।
তখন তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি একটা কোম্পানিতে চাকরি করি। আমার দুই ছেলে, এক মেয়ে। মাসে আমার এক বস্তা চাল লাগে। গত মাসেও এক বস্তা মিনিকেট চাল আমি কিনেছি ২২০০ টাকায়। সেই চালের বস্তা এখন হয়ে গেছে ২৭৫০ টাকা। বস্তাপ্রতি ৫০০ টাকা বেড়ে গেছে। আমাকে এই টাকা দিয়ে কিনতে হবে।’
চাল কিনতে গিয়ে ইসরাফিলের মতো এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি সব ক্রেতাই।

পুরান ঢাকার বাদামতলী ও বাবুবাজার চাল আড়ত। ছবি: আসাদুজ্জামান
পুরান ঢাকার বাদামতলী ও বাবুবাজার চাল আড়ত। ছবি: আসাদুজ্জামান


৩০ বছর ধরে চালের ব্যবসা করেন রফিকুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি পুরান ঢাকার বাদামতলী ও বাবুবাজার চাল আড়তদার সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
চালের দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে রফিকুল ইসলাম বললেন, চালের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। তারপরও চালের দাম সম্প্রতি বেড়েছে। এর জন্য দায়ী হলেন ক্রেতারা। করোনাভাইরাসে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কয়েক দিন ধরে চালের দোকানে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন ক্রেতারা। যে লোকের দরকার এক বস্তা চাল, তিনি কিনছেন পাঁচ বস্তা চাল। যাঁর দরকার দুই বস্তা, তিনি কিনছেন ১০ বস্তা চাল। ক্রেতারা প্রয়োজনের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি চাল কিনে রাখছেন। চালের এই অস্বাভাবিক চাহিদার কারণে চালের দাম বেড়েছে।

রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘১০ দিনের ব্যবধানে কেজিতে চালের দাম তিন থেকে চার টাকা বেড়ে গেছে। এর কারণ হচ্ছে, আমাদের এখান থেকে চালের মিলে অতিরিক্ত অর্ডার যাচ্ছে, চালের মিল-মালিকেরা চালের রেটটা (দাম) বাড়িয়ে দেয়। আমরা সাধারণত এক সপ্তাহ পর্যন্ত গোডাউনে চাল রাখি। এক সপ্তাহ ধরে চাল বিক্রি করার পর আবার আমরা চালের মিলে নতুন চাল সংগ্রহের অর্ডার দিই। এখন অনেক অর্ডার যাচ্ছে। তারাও বলছে, এত অর্ডার কেন? সে ক্ষেত্রে চালের মিলে দাম বেড়ে গেছে। আমাদের এখানেও চালের দাম বেড়েছে। খুচরা বাজারেও চালের দাম বেড়েছে।’

চালের দাম বাড়ার ব্যাপারে মিলমালিকদের ভূমিকা আছে, এমন অভিযোগের ব্যাপারে কুষ্টিয়ার রশিদ অ্যাগ্রো ফুড প্রোডাক্টের ঢাকা অফিসের কর্মকর্তা আবদুস সাত্তার বলেন, করোনাভাইরাসে আতঙ্কিত হয়ে অনেকেই বেশি বেশি চাল সংগ্রহ করেছেন, এই কারণে চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। চালের দাম কমে আসবে।

চাল ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম। ছবি: আসাদুজ্জামান
চাল ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম। ছবি: আসাদুজ্জামান

চালের আড়তদার বরকত উল্লাহ ও মনিরুজ্জামান জানান, কুষ্টিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের চালের মিলমালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করেন ঢাকার চালের আড়তদারেরা। এরপর বাবু বাজার, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন আড়তদারের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করে নিয়ে যান ঢাকার মহল্লার খুচরা দোকানদাররা। এই খুচরা দোকানদারদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করেন ক্রেতারা।

শেখ সাহিদ পরিবার নিয়ে থাকেন পুরান ঢাকার ধূপখোলা মাঠ এলাকায়। গতকাল শুক্রবার মহল্লার দোকানে যান চাল কিনতে। চালের দাম বেশি চাওয়ায় গতকাল তিনি চাল কেনা থেকে বিরত থাকেন। আজ শনিবার চলে আসেন বাবু বাজার চালের আড়তে।

শেখ সাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চালের দাম অনেক বেড়ে গেছে। যে মিনিকেট চালের দাম ছিল ৫০ টাকা, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। অনেক মানুষ ৮ থেকে ১০ বস্তা চাল কিনে রাখছেন, অথচ তার দরকার এক বস্তা। এ জন্য চালের দাম বেড়ে গেছে। এই সুযোগে অসাধু চাল ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
শোভা বেগম তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার এলাকায়। তাঁর স্বামী অসুস্থ হয়ে শয্যসায়ী। গতকাল স্থানীয় মহল্লায় চাল সংগ্রহ করতে দেখেন, চালের দাম অনেক বেশি। তাই আজ শনিবার দুপুরে চাল কিনতে আসেন বাবু বাজার চালের আড়তে। এখানেও দেখেন চালের দাম চড়া।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবেও চালের দাম বাড়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। শনিবারের খুচরা বাজারদর অনুযায়ী, প্রতি কেজি সরু মিনিকেট বা নাজির চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬৫ টাকায়। সাত দিন থেকে (১৪ মার্চ) সরু মিনিকেটের দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। পাইজাম চাল (মাঝারি) কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৮ টাকায়। ১৪ মার্চ বিক্রি হয়েছে ৪৫ থেকে ৫৫ টাকায়। মোটা চাল স্বর্ণা বা চায়না বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৩৮ থেকে ৫০ টাকায়। ১৪ মার্চ তা বিক্রি হয়েছে ৩৪ থেকে ৪০ টাকায়।

শোভা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। স্বামী অসুস্থ। মোটা চাল খাই। যে চালের বস্তা ছিল ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা। সেই চালের বস্তা এখন ১৯০০ টাকা। এত টাকা দিয়ে আমরা কীভাবে চাল কিনব? সরকার যদি এ ব্যাপারে নজর না দেয়, তাহলে আমরা কীভাবে চলব? কীভাবে সংসার চালাব? এটা কি মগের মুল্লুক নাকি?

চাল ক্রেতা শেখ সাহিদ। ছবি: আসাদুজ্জামান
চাল ক্রেতা শেখ সাহিদ। ছবি: আসাদুজ্জামান

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বহু মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করছেন। এর সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এই অসাধু চাল ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। করোনাভাইরাসের মতো কঠিন সময়ে বাজার অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষেরা চরম বিপদে পড়বেন। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যদি না থাকে, সেটা হবে আরও খারাপ।