'বেশি দিন চললে তো না খাইয়া মরা লাগব'

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর ঢাকায় মানুষের চলাফেরা অনেকটাই কমেছে। ছবি: দীপু মালাকার
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর ঢাকায় মানুষের চলাফেরা অনেকটাই কমেছে। ছবি: দীপু মালাকার

প্রেসক্লাব থেকে কারওয়ান বাজার যাব, ভাড়া জিজ্ঞেস করতেই সিএনজি অটোরিকশাচালক কাওসার মিয়া বলেন, ‘আপনি যা দিবেন তা–ই, মিটারে গেলেও যামু।’ গন্তব্যে যাওয়া নিয়ে সিএনজি অটোচালকদের সঙ্গে যাত্রীদের খিটিমিটি নতুন নয়। কিন্তু তাঁদের হঠাৎ এই আচরণের হেতু বিশ্বজুড়ে চলা করোনাভাইরাসের প্রকোপ। বাংলাদেশও এ ভাইরাসে আক্রান্ত।

সড়ক বেশ ফাঁকা। তিনি পথ ধরলেন কাজী নজরুল ইসলাম সড়কের দিকে। অন্যান্য সময় এ সড়কটিতে গাড়িগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সেদিন তিনি একটানে পৌঁছে দেন। এর মধ্যেই কাওসার মিয়ার আফসোস, ‘এখন আর ভাড়া নিয়া কিছু কই না। যে যা দেয় তাতেই যাই। পেট তো চালাইতে হবে।’ জানতে চাইলাম, দুপুর পর্যন্ত কেমন আয় হলো? ‘সকাল ৮টায় বাইর হইছি, এখনো জমার টাকা উঠে নাই।’ কাওসার মিয়ার উত্তর।

মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস বাংলাদেশে শনাক্তের খবর জানানো হয় ৮ মার্চ। এরপর থেকে বেড়েই চলেছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) আজ জানিয়েছে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ২৭ এবং মৃত ২।

মানুষকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সব ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সড়কে চলাচল কমে গিয়েছে। মানুষ রাজধানী ছাড়ছে। এক সপ্তাহ ধরেই মানুষ বের হচ্ছে কম। গত বুধবার করোনাভাইরাসে প্রথম মৃতের খবর জানার পর সবকিছু আরও ফাঁকা হয়েছে। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর বিপদ বেড়েছে। তাঁরা বলছেন, পেটের দায়ে বের না হয়ে উপায় নেই।

মো. আলমের চায়ের দোকানে প্রতিদিন প্রায় তিন শ কাপ চা বিক্রি হয়। পান্থপথের এই দোকানির চা বিক্রি এখন ৮০ কাপে এসে ঠেকেছে। দোকানে আসা চা–পিপাসুদের আলাপচারিতা থেকে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছুটা জানেন। ঘরে থাকা দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে তাই বের হতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু নিজে বের হন। তিনি বলেন, ‘চা না বেচলে তো পেট চলব না।’

রিকশাচালক সোবহান শিকদার বলেন, ‘খ্যাপ কইমা গেছে। একবার ভাবছিলাম বাড়ি চইলা যাই। কিন্তু গেলে তো বইয়া থাকন লাগব। খামু কী?’ দুদিন ধরে তাঁর আয় একমদই কম জানালেন। উল্টো প্রশ্ন করলেন? ‘এই অবস্থা কত দিন চলব? বেশি দিন চললে তো না খাইয়া মরা লাগব।’

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর ঢাকায় মানুষের চলাফেরা অনেকটাই কমেছে। ছবি: দীপু মালাকার
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর ঢাকায় মানুষের চলাফেরা অনেকটাই কমেছে। ছবি: দীপু মালাকার

একদিকে করোনায় সব বন্ধ হয়ে যাবে কি না, সেই ভয়ে সামর্থ্যবানেরা বেশি বেশি করে খাদ্যও প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে রাখছেন। তার ওপর সব জিনিসের দাম অনেক বেড়েছে। কিন্তু এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর একসঙ্গে অনেক কেনার টাকা নেই এবং বাড়তি দাম তাদের জন্য আরও বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাশ দিয়ে যেতেই কারওয়ান বাজারের ডাব বিক্রেতা আবদুর রহিম ডাব হাঁক দিলেন, ডাব খেয়ে যান।’ বিক্রি কেমন? ‘নাই। আগে দুই শ, আড়াই শ বেচতাম। কিন্তু এখন এক শ–ও বেচা হয় না।’ তিনি জানান, শহরের মানুষ আরও কমে গেলে হয়তো তিনিও গ্রামের পথ ধরবেন। কারওয়ান বাজারেই ট্রাক থেকে পড়ে যাওয়া ও পারিশ্রমিক হিসেবে পাওয়া কিছু সবজি নিয়ে পথের ধারে বসে যান সায়রা খাতুন। নিম্ন আয়ের মানুষেরাই তাঁর ক্রেতা। কিন্তু সেই মানুষদেরও অনেকে ঢাকা ছেড়েছেন। তাই সায়রা খাতুনের লাউ, পেঁপে, কিছু বেগুন রোদে শুকাচ্ছে। এখনো বিক্রি হয়নি। তিনি বলেন, বুঝতাছি না কী হইব। কী এক ভাইরাস আইছে, মানুষ ডরে বাইরায় না। আমরা কেমনে চলমু?’