'দেশটাকে ইতালির মতো মৃত্যু-উপত্যকা বানাবেন না, প্লিজ'

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর গ্রামের দুই ভাই উৎপল দাস ও বিকাশ দাস। ইতালির রোমে থাকেন তাঁরা। ২০ বছরেরও বেশি হয়ে গেছে। ১৭ জানুয়ারি দুই ভাই বাংলাদেশে এসেছিলেন, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে। ছুটি শেষে ২৪ ফেব্রুয়ারি রোমে ফিরে যান তাঁরা। কিন্তু ইতালিতে তত দিনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লকডাউন করেছে। ১০ মার্চ থেকে ঘরেই আছেন উৎপল।

গতকাল সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টার দিকে ম্যাসেঞ্জারে উৎপল দাসের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা লাখো বাংলাদেশি ইতালিতে মৃত্যুকূপের মধ্যে আছি। সুযোগ থাকার পরও বাংলাদেশের বিপদ বাড়বে বলে দেশে ফিরিনি। ইউরোপের মতো উন্নত দেশগুলো করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। সেখানে হাজারো সীমাবদ্ধতা থাকা আমাদের দেশ কতটা অনিরাপদ, তা বুঝতে পারছি।’

উৎপল দাস এই মুহুর্তে বাংলাদেশে অবস্থান করা প্রবাসীদের উদ্দেশে বলেন, ‘যাঁরা বাংলাদেশে ফিরে গেছেন, তাঁরা দেশকে নিরাপদে রাখুন। সরকারের আদেশ মেনে কোয়ারেন্টিনে থাকুন। দেশকে বিপদমুক্ত রাখুন। আমরা প্রবাস থেকে টাকা আয় করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখি। অথচ আজ আমাদের অসচেতনতা বাংলাদেশের জন্য বড় বিপদ ডেকে এনেছে। এ দায় আমরা এড়াতে পারব না। দেশের মানুষ আমাদের ক্ষমা করবে না।’

নড়িয়ার ঘড়িসার এলাকার এক বাসিন্দা ১৫ বছর ধরে ভেনিসে থাকেন। তিনি গতকাল রাতে ম্যাসেঞ্জারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ভেবেছি করোনাভাইরাস যদি আমার মাধ্যমে বাংলাদেশে যায়, পরিবারের লোকজনসহ দেশের মানুষ সংক্রমিত হবে। দেশটা ইতালির মতো মৃত্যু–উপত্যকা হয়ে যাবে। কিন্তু হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশে গেছেন। তাঁরা নিজেরা আক্রান্ত হয়েছেন। আত্মীয়স্বজনকে সংক্রমিত করেছেন। মৃত্যুর মিছিলে বাংলাদেশকে যুক্ত করেছেন। প্রবাস থেকে যাঁরা দেশে ফিরেছেন, তাঁদের প্রতি অনুরোধ, নিজেকে দুই সপ্তাহ সবার থেকে দূরে রাখুন। দেশটাকে ইতালির মতো মৃত্যু–উপত্যকা বানাবেন না, প্লিজ।’

ডামুড্যার কাইলারা এলাকার যুবক কিশোর কুমার ভেনিসে থাকেন। তিনি গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন,‘এখন ইতালির আবহাওয়া বেশ স্যাঁতস্যাঁতে। বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়া বইছে। ১৫ দিন ধরে ঘরে আটকা আছি। ঘরে পর্যাপ্ত খাবার আছে। দেশ থেকে স্বজনেরা জানান, ইতালিফেরতদের বাড়িতে পুলিশ লাল পতাকা টানিয়ে দিচ্ছে। তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়। ইতালিতে তো আমরা সরকারের সব নিয়ম মেনে চলি। তাহলে দুর্যোগের সময় নিয়ম মানছি না কেন? কেন প্রিয় মাতৃভূমিকে ইতালির মতো মৃত্যু–উপত্যকা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি?’

 যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় থাকেন নড়িয়ার মশুরা গ্রামের সুমন ঘোষ। তিনি গতকাল রাতে বললেন, ‘বাংলাদেশের স্বজনের জন্য শঙ্কা হয়। যখন শুনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে কেউ দেশের কাউকে সংক্রমিত করেছেন, তখন নিজেকে অপরাধী লাগে। নিজের প্রিয় মাতৃভূমিকে নিরাপদ রাখতে পারলাম না।’

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, শরীয়তপুরের দেড় লাখ মানুষ প্রবাসে থাকেন, যার ৮০ শতাংশ ইতালিতে থাকেন। এর মধ্যে নড়িয়ার বাসিন্দা ৭০ শতাংশ। ইতালিপ্রবাসীরা প্রতিনিয়ত শরীয়তপুরে যাতায়াত করছেন।

অভিবাসন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ১৫ থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত ২ হাজার ৮৩৮ জন প্রবাসী দেশে এসেছেন, যাঁদের বাড়ি শরীয়তপুর। এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ মার্চ পর্যন্ত আরও পাঁচ হাজার প্রবাসী শরীয়তপুরে এসেছেন। এর মধ্যে হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন মাত্র ৩৬৪ জন। আর হোম কোয়ারেন্টিন শেষ করেছেন ১৫৮ জন। দুজনের স্বাস্থ্য পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।


শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, ‘শরীয়তপুরে এসেছেন—এমন প্রবাসীদের তথ্য পেয়ে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। যাঁরা সরকারের নির্দেশ মানছেন না, তাঁদের সংক্রামক রোগ বিস্তার রোধ আইনের আওতায় এনে জরিমানা করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন স্থানে ১৩ জনকে জরিমানা করা হয়েছে।’