৮% মানুষ হোম কোয়ারেন্টিনে

১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ মার্চ—এই এক মাসে দেশি-বিদেশি ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৯৫৩ জন আকাশ, স্থল ও নৌপথ ব্যবহার করে বাংলাদেশে এসেছেন। আর এই সময়ের মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত হোম কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) আছেন ৩৭ হাজার ৩৮ জন। অর্থাৎ সাড়ে ৮ শতাংশের কম মানুষ নিয়ম মেনে ঘরে থাকছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, এঁরা শুধু প্রবাসী নন, তাঁদের সংস্পর্শে এসেছেন এমন ব্যক্তিও আছেন।

অন্তত ২০টি জেলার পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, তালিকায় থাকা বেশির ভাগ প্রবাসীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁরা ঠিকানা হিসেবে জেলাগুলোর নাম ব্যবহার করলেও অন্যত্র থাকছেন। বিভিন্ন জেলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশফেরতদের বড় অংশই সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি করছেন। এঁদের সবাইকে খুঁজে বের করা শুধু প্রশাসনের পক্ষে দুরূহ। এ পরিস্থিতি সারা দেশের মানুষকে অনিরাপদ করে তুলেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এক মাসে প্রায় ৪ লাখ ৪০ হাজার মানুষ এসেছেন ১৭৫টি দেশ থেকে। তাঁদের মধ্যে ২ লাখ ৯৩ হাজার প্রবাসী। বাকিরা বিভিন্ন কাজে বাইরে ছিলেন, দেশে ফিরেছেন। আবার কিছু বিদেশিও রয়েছেন। বাংলাদেশে এসে তাঁদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা। কিন্তু বিমানবন্দর, স্থলবন্দর বা সমুদ্রবন্দরে তাঁদের সেই পরামর্শ আগে দেওয়া হয়নি বলে বিদেশফেরত অনেকেই অভিযোগ করেছেন। তবে অতি সম্প্রতি এ ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করায় তাঁরা কোয়ারেন্টিনে থাকতে শুরু করেছেন। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ মার্চ পর্যন্ত যাঁরা এসেছেন, তাঁদের বিমানবন্দরে তাপমাত্রা মেপে ছেড়ে দেওয়া হয়।

>

প্রবাসী ও অন্যরা মিলে এক মাসে দেশে এসেছেন ৪ লাখ ৪০ হাজার। কোয়ারেন্টিনে শুধু ৩৭ হাজার মানুষ।

১৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে করোনাভাইরাস-সংক্রান্ত এক জরুরি সভা হয়। এ সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে বিদেশফেরতদের তালিকা চাওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার প্রতিবেদনে বলেছে, ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, তালিকা ধরে প্রত্যেককে খুঁজে বের করে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠাতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধু প্রবাসীদের নয়, তাঁদের স্বজন এবং যারা সংস্পর্শে ছিল, তাদেরও কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে। কেউ না মানলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (এনটিএমসি) একটি সূত্র জানায়, ১৭৫টি দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের তালিকা গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। জেলা প্রশাসকদের কাছেও এই তালিকা গেছে। প্রবাসী ও যাঁরা বিদেশ ঘুরে এসেছেন, তাঁদের মুঠোফোনে খুদেবার্তা দিয়ে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় পুলিশকেও বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে।

এনটিএমসির পরিচালক জিয়াউল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তালিকা পাওয়ার পরই আমরা তাঁদের পাসপোর্ট দেখে নম্বর সংগ্রহ করেছি। এর মধ্যে তিন লাখ লোকের নম্বরে আমরা এসএমএস পাঠিয়েছি। জেলাগুলোতে এঁদের নাম-ঠিকানা ও ফোন নম্বর পাঠানো হয়েছে। তাঁদের স্বজনদের জানানো হয়েছে।’

এনটিএমসির তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই এক মাসে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি দেশি-বিদেশি লোক এসেছেন, ৮৪ হাজার ৮২৭ জন। এ ছাড়া যশোরে ৪৪ হাজার ৮৫৮ জন, চট্টগ্রামে ৩৫ হাজার ৩৩৭, কুমিল্লায় ২০ হাজার ৮৮, সাতক্ষীরায় ১৪ হাজার ৩৩২, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৩ হাজার ৫৬০, খুলনায় ১০ হাজার ৬৮১ এবং সিলেটে ১১ হাজার ২০৮ জন এসেছেন। আরও এসেছেন মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, ফেনী, দিনাজপুর, মাদারীপুর, কক্সবাজার, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়। 

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বলা হয়েছে ১ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত যাঁরা বিদেশ থেকে এসেছেন, তাঁদের হোম কোয়ারেন্টিনে রাখতে। তাঁরা তিন হাজার লোককে বাসায় কোয়ারেন্টিনে রেখেছেন। পুলিশ প্রবাসীদের বাড়িতে গিয়ে স্টিকার লাগিয়ে দিয়েছে। প্রবাসীদের বাড়িতে লাল পতাকা লাগানো হয়েছে। তাঁদের হিসাবে সাড়ে ৯ হাজার ব্যক্তি বিদেশ থেকে এসেছেন। কিন্তু এনটিএমসির হিসাবে এই সংখ্যা ১৪ হাজার ৩৩২।

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর বলেন, তাঁদের এলাকায় ১ হাজার ৮৩ জন হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন। বাকিরা কুমিল্লার ঠিকানা ব্যবহার করলেও এখানে নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ওই এক মাসে কুমিল্লার ঠিকানা ব্যবহার করে ২০ হাজার ৮৮ জন বাংলাদেশে এসেছেন।

মাদারীপুরে ৪ হাজার ৬৩০ জন এসেছেন বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তবে জেলা পুলিশ সুপার মো. মাহবুব হাসান বলেন, ১০ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত প্রশাসনের হিসাবে ৩ হাজার ৪০৩ জন মাদারীপুরের ঠিকানা ব্যবহার করে দেশে এসেছেন। আর হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন মাত্র ৩২৬ জন। বাকিদের তাঁরা খুঁজে বের করতে পারেননি। তিনি জানান, মাদারীপুরে ১০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছিল, একজন সেরে উঠেছেন।

কোন দেশ থেকে কত এসেছেন

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এক মাসে সবচেয়ে বেশি লোক এসেছে ভারত থেকে, ২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৮৬ জন। সৌদি আরব থেকে ৪১ হাজার ৬৬১, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৩৭ হাজার ৩২১, মালয়েশিয়া থেকে ১৮ হাজার ৯৪২, কাতার থেকে ১৩ হাজার ৮৬৫, সিঙ্গাপুর থেকে ১২ হাজার ৩৪২, ওমান থেকে ১১ হাজার ৭৮৪, যুক্তরাজ্য থেকে ১০ হাজার ৫৩১, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭ হাজার ২৭৩, থাইল্যান্ড থেকে ৮ হাজার ২১৭, কুয়েত থেকে ৬ হাজার ১২০, স্পেন থেকে ৩ হাজার ৯০, শ্রীলঙ্কা থেকে ৩ হাজার ২৯০, চীন থেকে ৩ হাজার ৩৫, ইতালি থেকে ২ হাজার ৭০৩, মালয়েশিয়া থেকে ১ হাজার ৫০৯ জন।

বিদেশফেরতদের ফোনে খুদে বার্তা

করোনা মোকাবিলায় বিদেশফেরত ও তাঁদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা দিয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হয়েছে।

খুদে বার্তায় বলা হয়েছে, ‘আপনি বা আপনার নিকটজন সম্প্রতি বিদেশ হতে ফেরত এসেছেন। করোনা প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে আপনার অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করুন, করোনা মোকাবিলায় জাতিকে সহায়তা করুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। যার যার অবস্থান থেকে করোনা মোকাবিলায় জাতিকে সহায়তা করুন। নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে জেল বা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।’—স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সরকার সব কিছুতেই সবসময় ঢিলেমি করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি বলেন, এখনই অনেক স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে বিদেশফেরত সবাইকে খুঁজে বের করতে হবে। তাঁদের মধ্যে একজনের শরীরেও যদি এই ভাইরাস পাওয়া যায়, তাহলে তার আশপাশের এক মাইল এলাকার সব বাসিন্দাদের পরীক্ষা করতে হবে। বিষয়টি ব্যয়বহুল হলেও সরকারকে তা করতে হবে।