'কেমনে সন্তানের মুখে ভাত তুলে দেব'

প্রতিবন্ধী শিশু রমজান। বয়স আট বছর। সে তার মা জয়নুবা বেগমের সঙ্গে জুরাইনে থাকে। জয়নুবা বেগম গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় খবর পান, সদরঘাটে আজ বুধবার চাল-ডাল দেবে একটি সংস্থা। তাই প্রতিবন্ধী শিশু রমজানকে নিয়ে সকাল আটটায় চলে আসেন সদরঘাটের কাউন্সিলর অফিসে।

জয়নুবা বেগম দেখতে পান, চাল-ডাল সংগ্রহের জন্য শত শত মানুষ এসেছে। ভিড় ঠেলে প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে তিনিও দাঁড়িয়ে যান লাইনে। কিন্তু লোকজনের ঠেলাঠেলিতে রমজান একপর্যায়ে নিচে পড়ে যায়।

চাল-ডাল সংগ্রহ করতে প্রতিবন্ধী সন্তান রমজানকে নিয়ে জুরাইন থেকে সদরঘাটে আসেন জয়নুবা বেগম (বাঁ দিকে প্রথম)। সেখানে মানুষের ভিড়ের মধ্যে পড়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে রমজান। ঢাকা, ২৫ মার্চ। ছবি: আসাদুজ্জামান
চাল-ডাল সংগ্রহ করতে প্রতিবন্ধী সন্তান রমজানকে নিয়ে জুরাইন থেকে সদরঘাটে আসেন জয়নুবা বেগম (বাঁ দিকে প্রথম)। সেখানে মানুষের ভিড়ের মধ্যে পড়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে রমজান। ঢাকা, ২৫ মার্চ। ছবি: আসাদুজ্জামান

কান্নাজড়িত কণ্ঠে জয়নুবা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাল-ডাল সংগ্রহ করতে পারিনি। মানুষের ঠেলাঠেলির কারণে রমজান নিচে পড়ে যায়। মানুষের পায়ের পাড়ায় সে অসুস্থ হয়ে পড়ে।’

জয়নুবা বেগম বলেন, ‘একটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানে আমি চাকরি করি। দেশে করোনাভাইরাস আসায় গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেছে। হাতে টাকাপয়সা নেই। ঘরে খাবার নেই। বড় দুশ্চিন্তায় আছি। কেমনে সংসার চালাব? কেমনে সন্তানের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেব?’

কেবল জয়নুবা বেগম নন, নিম্ন আয়ের মানুষের মাথায় এখন রাজ্যের দুশ্চিন্তা। তাঁদের জিজ্ঞাসা, বন্ধের সময় কীভাবে তাঁরা সংসার চালাবেন? করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য সরকারি সিদ্ধান্তে দোকানপাট, কলকারখানা, স্কুল-কলেজ, বাস-লঞ্চ-ট্রেন সবই বন্ধ।

ওএমএসের চাল-আটা কেনার জন্য লাইনে নিম্ন আয়ের মানুষেরা। দয়াগঞ্জ, ২৫ মার্চ। ছবি: আসাদুজ্জামান
ওএমএসের চাল-আটা কেনার জন্য লাইনে নিম্ন আয়ের মানুষেরা। দয়াগঞ্জ, ২৫ মার্চ। ছবি: আসাদুজ্জামান

সকাল সাতটায় কামরাঙ্গীরচর থেকে সদরঘাটে আসেন সালমা বেগম। ভিড় ঠেলে সালমা বেগম দুপুর ১২টায় চাল-ডাল সংগ্রহ করেন।

সালমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের তিন ছেলে, এক মেয়ে। স্বামী অসুস্থ। কাজে যেতে পারেন না। কামরাঙ্গীরচরের একটি কারখানায় কাজ করে সালমা সংসার চালান। কিন্তু করোনার কারণে কারখানা দুই দিন আগে বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরে খাবার নেই। তাই সদরঘাটে এসেছেন চাল-ডাল নিতে। এই চাল-ডাল বিতরণ করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাজেদা ফাউন্ডেশন।

সাজেদা ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা রাহেবা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে হতদরিদ্র মানুষের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। যে কারণে তাঁদের প্রতিষ্ঠান ৬০০ পরিবারকে বিনা মূল্যে পাঁচ কেজি চাল, দুই কেজি ডাল এবং দুটি করে সাবান দিচ্ছে।

আকলিমা বেগম নামের এক নারী বলেন, করোনাভাইরাস আসার কারণে বড় বিপদে আছেন তাঁরা। কাজ নেই। এই সময়ে সরকার যদি তাঁদের মতো হতদরিদ্র মানুষদের মধ্যে কম টাকায় চাল, ডাল, তেল, আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিতরণ করে, তাহলে বড় উপকার হবে। দুপুর ১২টার দিকে তিনি জানান, সকালে এসেও তিনি চাল-ডাল সংগ্রহ করতে পারেননি।

চাল-ডাল সংগ্রহ করতে সদরঘাটে কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনে ভিড় করেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। ঢাকা, ২৫ মার্চ। ছবি: আসাদুজ্জামান
চাল-ডাল সংগ্রহ করতে সদরঘাটে কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনে ভিড় করেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। ঢাকা, ২৫ মার্চ। ছবি: আসাদুজ্জামান

ওএমএসের ট্রাকের সামনে কদবানু
কদবানু বেগম থাকেন সায়েদাবাদে। সকালেই খবর পান, দয়াগঞ্জে ওএমএসের আটা বিক্রি হচ্ছে। বেলা ১১টা নাগাদ দয়াগঞ্জে চলে আসেন তিনি।
কদবানু প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তা–ও জানেন না। তাই আটা সংগ্রহ করার জন্য এখানে এসেছেন।

খাদ্য অধিদপ্তর পরিচালিত ওএমএসের ট্রাকের সামনে কদবানুর মতো আরও বহু মানুষ চাল–আটা কেনার জন্য ভিড় করেন।

আফসানা খাতুন নামের এক নারী বলেন, ‘সবকিছু বন্ধ। আমাদের কাজ নেই। আমরা দিন আনি দিন খাই। গরিব মানুষ বড়ই বিপদে আছি। এখন সরকার যদি আমাদের না দেখে, কম টাকায় যদি চাল-ডাল না দেয়, তাহলে আমরা কোথায় যাব? কী করব? কিছুই বুঝতে পারছি না।’

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের এই কঠিন সময়ে হতদরিদ্র মানুষদের কথা সরকারকে ভাবতে হবে। কম টাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তাঁদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে।