করোনায় সুরক্ষা পোশাকের সংকট কাটছে না

দেশে কোভিড–১৯ আক্রান্ত রোগী বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়টি সামনে এসেছে। পর্যাপ্ত ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী না থাকায় চিকিৎসকদের মধ্যে অনিরাপদবোধ কাজ করছে। এই জরুরি পরিস্থিতিতে অনেকেই মানহীন সামগ্রী বিক্রি করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চাপ দিচ্ছে।

ডিসেম্বরের শেষের দিকে চীন থেকে বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর ২৮ ফেব্রুয়ারি বৈশ্বিক সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর ১১ দিন পর ১১ মার্চ সংস্থাটি এ রোগকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে শুরু থেকে এই নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা ছিল। একই সঙ্গে প্রস্তুতি নিয়েও নানা আলোচনা হয়েছে। 

৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকদের অসন্তোষের খবর প্রকাশ পেতে থাকে। ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী বা পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট না পেলে দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানান কিছু হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। ঢাকায় চিকিৎসকদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছেন এমন খবরও আছে। রাজশাহী, সিলেট ও খুলনা শহরে কয়েকটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা কর্মবিরতিতেও গেছেন। তাঁদের মূল দাবি, পিপিই ছাড়া তাঁরা কাজে যাবেন না। কিন্তু দেশে পিপিইর সংকট যেমন আছে, তেমনি পিপিইর মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

কেন্দ্রীয় ঔষধ ভান্ডারের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শহীদউল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়, নিতে হচ্ছে। যার ভাতের দরকার, তার জন্য পোলাও–মাংসের কথা ভাবলে হবে না। মানের কথা চিন্তা করে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না।’

গতকাল বুধবার মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামলাতে এ পর্যন্ত ৩ লাখ ৫৭ হাজার পিপিই কেন্দ্রীয় ঔষধ ভান্ডার সংগ্রহ করেছিল। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ইতিমধ্যে ২ লাখ ৯১ হাজার সরবরাহ করা হয়েছে। আর মজুত আছে ৬৬ হাজার। 

প্রয়োজনের তুলনায় সংগ্রহ, মজুত ও বিতরণ খুই সামান্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা) অধ্যাপক ইকবার কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী তিন মাসে আমাদের ১০ লাখ পিপিই দরকার। আর প্রতি মাসে মাস্ক দরকার ১০ লাখ।’

মান বনাম প্রয়োজন

কোভিড–১৯ রোগীদের সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর তালিকা ও তার মান ঠিক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর মধ্যে আছে—হাত পরিষ্কার রাখার দ্রবণ, অ্যাপ্রোন, মেডিকেল বর্জ্যের জন্য ব্যাগ, হাসপাতাল পরিষ্কার করার দ্রবণ, মুখ ঢাকার সরঞ্জাম, গ্লাভস, চশমা (গগলস), গাউন, মেডিকেল মাস্ক, রেস্পিরেটর, কাঁচি রাখার বক্স। 

>করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট মানের কাপড়ের কথা বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কে পরবে, কে পরবে না, তা-ও বলা আছে।

চিকিৎসকেরা বা নার্সরা যে গাউন ব্যবহার করবেন, তার কাপড় হতে হবে তরল প্রতিরোধী। তা ছাড়া কাপড় হবে রক্তজাত জীবাণু প্রতিরোধী। এসব সামগ্রী একবার ব্যবহারের পর তা ফেলে দিতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত পিপিই বাংলাদেশে কী পরিমাণ ছিল, কী পরিমাণ বিতরণ করা হয়েছে, তার তথ্য সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর থেকে পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অভিযোগ উঠেছে, চিকিৎসকেরা মানসম্পন্ন পিপিই পাননি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট মানের কাপড়ের কথা বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মান বজায় না রাখলে আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। অর্থাৎ চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হবে।’ 

কার প্রয়োজন

কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, প্রশাসনের লোক পিপিই পরছেন। একটি জেলার জেলা প্রশাসক পিপিই পরে ছবি তুলেছেন। এটা ঠিক নয়। সবার জন্য পিপিই নয়। যার প্রয়োজন তিনিই পরবেন। অন্যরা পরলে সম্পদের অপচয় হবে। 

পিপিই কে পরবেন আর কে পরবেন না, তারও নির্দেশনা আছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। সংস্থাটির নির্দেশনা অনুসরণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি নির্দেশনা তৈরি করেছে। অন্তর্বিভাগে, বহির্বিভাগে কারা ব্যবহার করবেন, তাঁদের কথা উল্লেখ আছে। এঁদের মধ্যে আছেন চিকিৎসক, নার্স, ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী। রোগীর সংস্পর্শে আসার কোনো আশঙ্কা নেই হাসপাতালের এমন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পিপিইর প্রয়োজন নেই বলে সরকারি নির্দেশনায় বলা আছে।

আন্তর্জাতিক বন্দরে, রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের চালক তাঁরা কোন মানের পোশাক পরবেন, তা–ও সুনির্দিষ্ট করে বলা আছে। গ্রাম এলাকায় র‌্যাপিড রেসপন্স টিমের সদস্যদের জন্য কোন ধরনের পোশাক ব্যবহার করতে হবে, তারও নির্দেশনা আছে।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) আমিনুল হাসান স্বাক্ষরিত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো রোগীর কোভিড-১৯–এর লক্ষণ থাকে, তবে প্রথমে চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দেবেন এবং প্রয়োজনে পিপিই পরিধানকৃত দ্বিতীয় চিকিৎসকের কাছে প্রেরণ করবেন এবং তিনি পিপিই পরিহিত অবস্থায় রোগীকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করিবেন।’ ওই আদেশে আরও বলা হয়, সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসক কোনো রোগীকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারবেন না। 

কিন্তু প্রথম চিকিৎসক নিজের সুরক্ষা ছাড়াই কীভাবে সেবা দেবেন, তা চিঠিতে উল্লেখ নেই। রাতে আমিনুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ওই চিঠি স্থগিত করা হয়েছে।

পিপিই নিতে চাপ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, পিপিইর সংকটের কথা জানার পরপরই বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সরকারকে পিপিই দিতে চাচ্ছে। পিপিই কেনার জন্য কেউ কেউ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চাপ দিচ্ছে। কেউ কেউ পিপিই অনুদান দেবার নাম করে সাধারণ কাপড়ের গাউন দিয়ে যাচ্ছে।

প্রথম আলো এ রকম তিনটি প্রতিষ্ঠানের পিপিই সরবরাহের অনুমোদনসংক্রান্ত কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যে নমুনা দেওয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত নিম্নমানের বলে সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন। অন্তত দুটি ক্ষেত্রে অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। 

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পিপিইর সংকট চলছে। আজ ১০ হাজার পিপিই চীন থেকে আসবে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুদিন আগে বলেছিলেন। কিন্তু তাতে সংকট মিটবে না।

বিএসএমএমইউর উপাচার্য বলেন, পোশাক তৈরির বিশ্বমানের কারখানা বাংলাদেশে আছে। এ ক্ষেত্রে দুটি কাজ করার আছে। প্রথমত দ্রুততম সময়ে মানসম্পন্ন কাপড় আমদানি করতে হবে। অথবা যে কাপড় আছে, তাকে উপযুক্ত মানে উত্তীর্ণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জরুরি সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।