যেভাবে দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে শালিখা

বাজারে আসা যানবাহনে জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছেন এক স্বেচ্ছাসেবী। বুনাগাতী, শালিখা, মাগুরা, ২৬ মার্চ। ছবি: প্রথম আলো
বাজারে আসা যানবাহনে জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছেন এক স্বেচ্ছাসেবী। বুনাগাতী, শালিখা, মাগুরা, ২৬ মার্চ। ছবি: প্রথম আলো

মাগুরার শালিখা উপজেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে প্রশাসনের নানা পদক্ষেপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চার শতাধিক তরুণের একটি স্বেচ্ছাসেবী দল। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ ভাগ করে নিয়ে সমন্বিতভাবে গ্রামে গ্রামে কাজ করছেন তাঁরা। পুরো বিষয়টি তদারক করছেন উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

শালিখা উপজেলা সদর থেকে বুনাগাতী বাজারের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, বুনাগাতী বাজারের প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে আছেন মাস্ক ও অ্যাপ্রোন পরা কয়েকজন যুবক। বাজারে প্রবেশ করতে যাওয়া সবার গতিরোধ করছেন তাঁরা। জানতে চাওয়া হচ্ছে বাজারে আসার উদ্দেশ্য। সবকিছু শুনে দ্রুত কাজ শেষ করে বাজার ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা। একই সঙ্গে বাজারে প্রবেশের সময় ভ্যান, ইজিবাইক বা অন্যান্য যানবাহনে জীবাণুনাশক স্প্রে করছিল দলটি। একই সময়ে বাজারের অন্য প্রান্তে আরও কয়েকজন তরুণ কাজ করছিলেন দোকানিদের সচেতন করতে।

এসব দলের সবাই শালিখা উপজেলা প্রশাসনের আহ্বানে সাড়া দেওয়া স্বেচ্ছাসেবী। তাঁদের একজন মাগুরা সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের সম্মান তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মো. সৈকত মাহামুদ। তিনি বলেন, ‘আমরা ১৭ মার্চ থেকে কাজ করছি গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে। উপজেলা প্রশাসন প্রতিদিন আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দিচ্ছে, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সেগুলো বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছি।’

স্বেচ্ছাসেবকদের এমন উদ্যোগে সাড়াও মিলছে ভালো। বুনাগাতি বাজারের ব্যবসায়ী গফুর বিশ্বাস বলেন, ‘২৫ তারিখ থেকেই আমাদের বাজার লকডাউন বলা যায়। স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারদের পাশাপাশি এলাকার শিক্ষিত ছেলেরা মাঠে নেমছে। তাদের আমরা ব্যবসায়ীরাসহ সাধারণ মানুষও সহযোগিতা করছে।’

বুনাগাতি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. বকতিয়ার উদ্দিন জানান, ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও ইউপি সদস্য, গ্রাম পুলিশ এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা শুরু থেকেই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছেন। আর তিনিসহ স্বাস্থ্য বিভাগের একজন মেডিকেল কর্মকর্তা, উপজেলা পরিষদের একজন কর্মকর্তা ও থানার একজন উপপরিদর্শক (এসআই) পুরো বিষয় সমন্বিতভাবে তদারক করছেন।
শালিখা উপজেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, পুরো উপজেলায় চার স্তরের কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রথমত প্রতিটি গ্রামে স্থানীয় তরুণদের নিয়ে একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা হয়েছে। তাঁরা হোম কোয়ারেন্টিন সম্পর্কে তথ্য প্রদান, সচেতনতামূলক কার্যক্রম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে নাগরিকদের জরুরি সেবা প্রদানসহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এরপর প্রতিটি ওয়ার্ডে ইউপি সদস্যদের নেতৃত্বে একটি করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাঁরা স্বাস্থ্য সহকারী, গ্রাম পুলিশ, আনসারসহ অন্য সদস্যদের নিয়ে হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করাসহ স্বেচ্ছাসেবক দলের সব কাজে সহযোগিতা করছেন। এ ছাড়া প্রতিটি ইউনিয়নে সরকার নির্ধারিত ইউনিয়ন কমিটি আছে। যেখানে ইউপি চেয়ারম্যান তাঁর ইউনিয়নে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ইউনিয়নের অন্যান্য কমিটি ও দলগুলোর কার্যক্রম নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং উপজেলা ভিজিলেন্স টিমের সঙ্গে সমন্বয় করছেন।

উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, প্রতিটি ইউনিয়নে একটি হটলাইন নির্ধারণ করা হয়েছে। কোনো তথ্য বা জিজ্ঞাসা থাকলে ওই নম্বরে ফোন করে জানতে পারছেন। হটলাইনে জানানো সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে একজন সরকারি কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন। তিনি নাগরিকদের সমস্যাসহ বিভিন্ন ইস্যু সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধান করছেন। প্রতিটি ইউনিয়নে পুলিশের একজন এসআই নিয়োজিত আছেন। স্বাস্থ্যগত পরামর্শের জন্য প্রতি ইউনিয়নে একজন চিকিৎসক নির্ধারণ করা আছে।

এ ছাড়া পুরো উপজেলায় নিয়োজিত কমিটিগুলোর সমন্বয় ও সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে ইউএনও, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি), থানার ওসি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সমন্বয়ে উপজেলা ভিজিলেন্স টিম গঠন করা হয়েছে। এই দল ইউনিয়ন ভিজিলেন্স টিমের সঙ্গে সমন্বয়ের পাশাপাশি জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করছে।

শালিখার ইউএনও তানভীর রহমান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, যেকোনো দুর্যোগের সময় সবচেয়ে আগে মাঠে পাওয়া যায় পুলিশ, আনসার, স্বাস্থ্যকর্মী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। তবে বড় কোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করে থাকেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। বিষয়টি মাথায় রেখে স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল গঠন করা হয়েছে। এই মুহূর্তে উপজেলার সাত ইউনিয়নের ৬৩ ওয়ার্ডে কাজ করছেন চার শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী। পরিস্থিতি অনুযায়ী এ সংখ্যা বাড়ানো যাবে। স্বেচ্ছাসেবক বাছাইয়ে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হয়েছে। এখানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা কমপক্ষে স্নাতকের ছাত্র বা পাস করে গেছেন এমন ব্যক্তি। এর বাইরে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের কর্মী, স্কুলশিক্ষকেরাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

ইউএনও জানান, প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবীসহ অন্যান্য যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হচ্ছে। এটা নিশ্চিত করতে না পারলে কাউকে কাজ করতে দেওয়া হবে না। কারণ, সঠিকভাবে বিষয়টি তদারক না করতে পারলে ফলাফল হিতে বিপরীত হতে পারে।