করোনা চিকিৎসায় চারটি হাসপাতাল এখনো প্রস্তুত নয়

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের বিপরীতে আউটার সার্কুলার রোডে সবুজে ঘেরা কয়েক একর জায়গাজুড়ে রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল। গতকাল শনিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতাল ভবন, ড্রেনেজ লাইন সংস্কার ও রং করার কাজ চলছে। নিচতলা ও দোতলায় কাজ করছেন ২০-২৫ জন শ্রমিক।

সংস্কারকাজের ঠিকাদার মো. শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ছয় দিন আগে কাজ শুরু করেছেন তাঁরা। আরও তিন-চার দিনের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন। তাঁর কথায় বোঝা গেল, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত এই হাসপাতাল প্রস্তুত হতে আরও সময় লাগবে।

রাজধানীতে এখন মূলত কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা হচ্ছে। এর বাইরে সরকার আরও সাতটি হাসপাতাল নির্ধারণ করেছে। এগুলো হচ্ছে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, মিরপুরের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতাল এবং বেসরকারি তিন হাসপাতাল রিজেন্ট হাসপাতাল, উত্তরা ও মিরপুর ও যাত্রাবাড়ীতে অবস্থিত সাজিদা ফাউন্ডেশন।

গতকাল সরকারি চারটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালগুলো এখনো প্রস্তুত নয়। আর বেসরকারি তিনটি হাসপাতাল চালু থাকলেও বড় পরিসরে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সক্ষমতা এগুলোর নেই।

মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, পুরান ঢাকার নয়াবাজারের মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, মিরপুরের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, কোনোটির এখনো সংস্কারকাজ চলছে। কোনোটিতে প্রয়োজনীয় লোকবল ও সামগ্রী নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষগুলো বলছে, পুরো প্রস্তুতি শেষে তাদের অন্তর্বিভাগে চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করতে অন্তত সাত দিন সময় লাগবে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়ার সুবিধা বা ভেন্টিলেশন জরুরি। কিন্তু এই চারটি নির্ধারিত হাসপাতালের তিনটিতেই আইসিইউ সুবিধা নেই। শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটেও আইসিইউ ছিল না, বসানোর কাজ চলছে। এই হাসপাতালে আটটি আইসিইউ শয্যা থাকবে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল শাখা) আমিনুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, রেলওয়ে হাসপাতালটি পরিত্যক্ত ছিল। সংস্কার করে চালু করতে সপ্তাহখানেক লাগবে। মহানগর হাসপাতালের বহির্বিভাগ চালু করা হয়েছে। মিরপুরের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়া বাকি। শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের বহির্বিভাগ দু-তিন দিনের মধ্যে চালু করা যাবে।

সংস্কারকাজ চলছে রেলওয়ে হাসপাতালে
রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালের ভবন, ড্রেনেজ লাইন সংস্কার ও রং করার কাজ চলছে। জানা গেছে, অবহেলায় পড়ে থাকা রেলওয়ে হাসপাতালটি কার্যকর করতে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল। তাতে অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। হাসপাতালে রোগীর আনাগোনাও বাড়েনি।

হাসপাতালের প্রবেশপথে জীর্ণ নামফলকে লেখা জেনারেল হাসপাতাল। কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সবার ধারণা, এটি শুধু রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য। পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় এখানে রোগীর তেমন একটা আসা-যাওয়া নেই। ভবনও অনেক পুরোনো। এখন তাড়াহুড়ো করে সংস্কার করা হচ্ছে।

প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ ফিরোজ আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ভবনটি পুরোপুরি তৈরি হতে অন্তত এক সপ্তাহ লাগতে পারে। এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহের ওপর নির্ভর করবে চিকিৎসা শুরুর কার্যক্রম। এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া গেলেও আইসিইউ সেবা দেওয়া সম্ভব নয়।

রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় চিকিৎসা কর্মকর্তা আবদুল আহাদ প্রথম আলোকে বলেন, আটজন চিকিৎসক যোগ দিয়েছেন, কিন্তু কোনো যন্ত্রপাতি আসেনি। ভবন প্রস্তুত হলে তাঁরা নিজেদের ১৫টি শয্যা তৈরি করবেন। তবে সরকার থেকে সরবরাহ করা হলে ১০০টি পর্যন্ত শয্যা বসানোর সুযোগ আছে।

চিকিৎসাসামগ্রী নেই মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতালে
মিরপুরের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত প্রয়োজনীয় লোকবল এবং চিকিৎসা সামগ্রী দেওয়া হয়নি। ২০০ শয্যার এই হাসপাতালে আইসিইউ নেই। আইসিইউ চালুর বিষয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

মিরপুরের লালকুঠিতে অবস্থিত মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতালটির পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নতুন হাসপাতাল। সীমিত পরিসরে বহির্বিভাগ চালু করা হয়েছিল। হাসপাতালে লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। তবে করোনা চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৭ চিকিৎসক ও ২৭ জন নার্স নিয়োগ দিয়েছে।

>

গতকাল সরকারি চারটি হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালগুলো এখনো প্রস্তুত নয়। আর বেসরকারি তিনটি হাসপাতাল চালু থাকলেও বড় পরিসরে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সক্ষমতা এগুলোর নেই।

এ হাসপাতালে কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মী, আয়া বা সহায়তাকারী নেই। হাসপাতালের অন্তর্বিভাগের শয্যাগুলোর কোনো চাদরও নেই। ফলে শয্যাগুলোও প্রস্তুত করা যাচ্ছে না। ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী এখনো পৌঁছায়নি। হাসপাতালে যাঁরা চিকিৎসক, নার্স আসছেন, তাঁদের খাবারের কোনো ব্যবস্থাও নেই।

গতকাল সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, পুরো হাসপাতালে সুনসান নীরবতা। দোতলায় হাসপাতালের প্রবেশ এবং বের হওয়ার দুটি আলাদা পথ প্রস্তুত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আসা চিকিৎসক-নার্সরা সাততলায় অবস্থান করছেন। অন্তর্বিভাগের শয্যাগুলোও অপ্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে।

হাসপাতালের পরিচালক শামছুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, এখানে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়নি। এটি এখনো প্রস্তুতির পর্যায়ে আছে। সহযোগী স্টাফ ছাড়া শয্যাগুলোও প্রস্তুত করা যাচ্ছে না। হাসপাতালে আইসিইউ চালু করার ব্যাপারে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি।

হাসপাতালে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের যাঁরা চিকিৎসাসেবা দেবেন, তাঁদের জন্য ৩০টি ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) দেওয়া হয়েছে। এগুলো ওয়ানটাইম বা একবার ব্যবহারের উপযোগী। আরও পিপিই সরবরাহ করা হবে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অপেক্ষায় মহানগর হাসপাতাল
পুরান ঢাকার নয়াবাজার এলাকায় বাবুবাজার সেতুর পাশেই ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল। হাসপাতালের দুজন চিকিৎসক জানান, ইতিমধ্যে হাসপাতালটি পুরোপুরি খালি করা হয়েছে। ২৫টি পিপিই হাসপাতালে পৌঁছেছে। বহির্বিভাগে রোগীর সেবা দেওয়া শুরু হয়েছে। এটি ১৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও বর্তমানে ১০০টি শয্যা সরবরাহ করা যাবে। তবে আইসিইউ সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না এখানে।

গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, পুরো হাসপাতাল সুরক্ষিত করতে বাইরে থেকে প্রবেশদ্বার বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সাধারণ মানের পিপিই পরিহিত অবস্থায় হাসপাতাল ভবনের ফটকে একজন দায়িত্ব পালন করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, সারা দিনে জ্বর নিয়ে কয়েকজন রোগী হাসপাতালে এসেছেন।

তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সারা দিনে পাঁচজন রোগী বহির্বিভাগ থেকে সেবা নিয়েছেন। এঁদের মধ্যে কাউকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মনে হয়নি। আক্রান্ত হওয়ার সন্দেহ দেখা দিলে আইইডিসিআরকে রক্তের নমুনা সংগ্রহের জন্য জানানো হবে। কেউ আক্রান্ত হলে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে বিশেষায়িত হাসপাতালে স্থানান্তর করা হবে।

হাসপাতালের পরিচালক প্রকাশ চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও সরঞ্জামাদি আসার ওপর পুরো কার্যক্রম নির্ভর করবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ১৬ জন চিকিৎসককে এ হাসপাতালে পদায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ জন মেডিকেল অফিসার যোগ দিয়েছেন কিন্তু ৪ জন কনসালট্যান্ট এখনো যোগ দেননি। তাই বহির্বিভাগে সেবা দিলেও কোনো রোগী ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না।

শেখ রাসেল হাসপাতালের আরও সময় লাগবে
করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য মহাখালীতে অবস্থিত শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এখনো প্রস্তুতি চলছে। আগামী ২ এপ্রিলের মধ্যে আইসিইউসহ চিকিৎসাসেবা শুরু করার আশা করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলায় আইসিইউর শয্যার বিভিন্ন অংশ জোড়া দেওয়ার কাজ চলছে। লেভেল-৫-এ হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিট করা হচ্ছে। সেখানে কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস দেওয়ার যন্ত্রপাতি বসানো হচ্ছে। লেভেল-৬-এ অবস্থিত হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডগুলো ফাঁকা করা হয়েছে। হাসপাতালের কর্মীরা সাধারণ ওয়ার্ডের শয্যাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে প্রস্তুত করছেন।

হাসপাতালের পরিচালক ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আইসিইউ ইউনিটে আটটি শয্যা থাকবে। আইসিইউর পাশে আট শয্যার একটি হাইডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) রয়েছে। এই আটটি শয্যাতেও আইসিইউ শয্যা চালুর বিষয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। আইসিইউ ইউনিটটি পুরো প্রস্তুত করতে দু-তিন দিন লাগবে।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, হাসপাতালের ১৪০ শয্যার সাধারণ ওয়ার্ড ও কেবিন চালু ছিল। সেগুলোতে গ্যাস্ট্রোলিভারের রোগীদের নতুন করে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না। তবে এখনো গ্যাস্ট্রোলিভারের বহির্বিভাগ চালু রাখা হয়েছে। ফারুক আহমেদ বলেন, হাসপাতালটি ২৫০ শয্যার। তবে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় কিছুটা দূরত্ব রাখতে হয়। তাই কিছু শয্যা কমিয়ে ১৬০ থেকে ১৭০টি করোনাভাইরাস আক্রান্তদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।

এই হাসপাতালে এখনো করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের ব্যবস্থা নেই। তবে এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনলাইনে হাসপাতালের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছে। ফারুক আহমেদ বলেন, এখন করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে কোনো রোগী এলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে নমুনা পরীক্ষার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে আরও বেশি হাসপাতাল প্রয়োজন হবে। তাই হাসপাতালগুলো প্রস্তুত করে রাখতে হবে। অন্তত করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে যাওয়া রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসাসুবিধা দেওয়ার জন্য কয়েকটি হাসপাতালে অন্তত বহির্বিভাগ চালু করা দরকার।