রোগী আসছেও কম, হাসপাতাল রাখছেও কম

রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে রোগী আসছে কম। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সকালের চিত্র। ছবি: শেখ সাবিহা আলম
রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে রোগী আসছে কম। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সকালের চিত্র। ছবি: শেখ সাবিহা আলম

করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট বা সুরক্ষা পোশাকের হাহাকার আর নেই। কিন্তু হাসপাতালে রোগী নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষগুলোর দাবি, রোগীরা আসছেন না। রোগীদের অভিযোগ হাসপাতালগুলো তাঁদের রাখছে না।

এমনকি রোববার রাতেও শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, তিনি সন্তানসম্ভবা ছিলেন। শারীরিক জটিলতার কারণে আলট্রাসাউন্ড প্রয়োজন পড়ায় সকাল থেকে ১১ টি হাসপাতালে ফোন করে শেষপর্যন্ত সন্ধ্যায় আলট্রাসাউন্ড করাতে সমর্থ হন। চিকিৎসক রিপোর্ট দেখে পরে জানান, গর্ভস্থ শিশুর হৃৎস্পন্দন থেমে গেছে। সে আর বেঁচে নেই। রোববার সকালে ১৬ ঘণ্টা ছয়টি হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে একজন মারা যাওয়ার খবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক দুই পক্ষই মনে করছেন এই পরিস্থিতি চলতে পারে না।

রোববার ও সোমবার রাজধানীর বড় ছয়টি সাধারণ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগী পাওয়া গেছে খুব কম। তবে চিকিৎসকদের মধ্যে পিপিইর জন্য যে হাহাকার ছিল, সেটা আর নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর হাসপাতালে এখন আর পিপিইর কোনো সংকট নেই। কিছু জমাও আছে। জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে এই মুহূর্তের পিপিইর আর কোনো সংকট নেই। জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটে হাসপাতালের চিকিৎসকদের পরিবহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্সগুলো ব্যবহার হচ্ছে। এর বাইরেও বিআরটিসির তিনটি বাস ভাড়া করা হয়েছে।

তাহলে রোগী কম কেন? জানতে চাইলে মোটামুটি একই জবাব পাওয়া গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ও জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের কাছে।

রোগী শূণ্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের শিশু ও সার্জারি ওয়ার্ড। ছবি: শেখ সাবিহা আলম
রোগী শূণ্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের শিশু ও সার্জারি ওয়ার্ড। ছবি: শেখ সাবিহা আলম

কর্তৃপক্ষগুলো বলছে, ঈদের ছুটিতে যত রোগী হাসপাতালে আসে, তার চেয়েও এখন কম। বেশির ভাগ মানুষ ঢাকা ছেড়ে গেছে। যানবাহনের সংকট একটা বড় সংকট। সরকারের তরফ থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হতে না বলার নির্দেশনা আছে। মানুষের মধ্যে ভীতি আছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ আগের মতো ব্যস্ত থাকলেও, অন্য বিভাগগুলোয় রোগী কমে গেছে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটে বহির্বিভাগ ও অন্তঃ বিভাগ মিলে প্রায় দুই হাজার রোগী থাকেন। আজ সকালে বহির্বিভাগে রোগী এসেছেন ৩৫ জন, ভর্তি আছেন ২১৫ জন। জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটে চিকিৎসকের কক্ষের বাইরে দায়িত্ব পালন করছিলেন দুজন কর্মী। তাঁদের একজন প্রথম আলোকে বলেন, সকাল থেকে বেলা ১২ টা পর্যন্ত ৩৫টা রোগী এসেছে। দিন শেষে হয়তো এই সংখ্যা শতখানেক হবে। স্বাভাবিক সময়ে হাজার খানের রোগী আসেন। এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক আজহারুল হক বলেন, রোগটা নিয়ে সামাজিক ভীতি ব্যাপক। বেসরকারি ক্লিনিকগুলো একরকম বন্ধ, সরকারি হাসপাতাল খোলা ।

আজ সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালে ঢোকার মুখে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আছে। জ্বর-হাঁচি-কাশি যাদের আছে তাঁরা যাচ্ছেন হাতের ডানদিকে, অন্য রোগে যারা আক্রান্ত তাঁরা যাচ্ছেন বাম দিকে। পিপিই পরে দোতলার প্রশাসনিক ব্লকের সামনের অংশ ঝাড়ু দিচ্ছিলেন এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তিনি বলেন, রোগী খুব কম। একটু ভালো হলেই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নারী ও শিশু ওয়ার্ড সকালে ছিল প্রায় ফাঁকা। মাস্ক মুখে দিয়ে করিডরে গল্প করছিলেন তিন ব্যক্তি। তাঁদের একজন শামসুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্ত্রী নার্গিস বেগম অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা নিয়ে শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন। চিকিৎসক না থাকায় তাঁরা অন্য হাসপাতালে পাঠান। বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ল্যাবএইড, পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে রাখা হয়েছে চিকিৎসাকর্মীদের জন আনা ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক। ছবি: শেখ সাবিহা আলম
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে রাখা হয়েছে চিকিৎসাকর্মীদের জন আনা ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক। ছবি: শেখ সাবিহা আলম

শনিবার এই হাসপাতাল থেকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা আলমাছ উদ্দিনকে। জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক উত্তম বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, রোগীর নিউমোনিয়া হয়েছিল। সব নথিপত্র আছে। নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখে ডিউটি ডাক্তাররা মনে করেছেন তিনি সন্দেহভাজন রোগী। এই হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ড থাকার পরও ভর্তি না করে ফিরিয়ে দেওয়া হলো কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন থেকে সন্দেহভাজন রোগীও ভর্তি করা হবে। তবে তারপরও করোনাভাইরাসের লক্ষণ আছে এমন রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হতে উৎসাহিত করা হচ্ছে না। সরকার নির্ধারিত হাসপাতালগুলো পূর্ণ হলে তাঁরা ভর্তি রাখতে ইচ্ছুক।

জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটের পরিচালক মীর জামালউদ্দীন বলেন,“হাসপাতালে মূলত হৃদরোগীরাই আসেন। সমস্যাটা হচ্ছে অন্য উপসর্গ থাকলে অনেকের অনাগ্রহ থাকে। আজ সকালেও একজন রোগীকে অন্য হাসপাতালে রেফার করে দেওয়া হচ্ছিল। আমি রেখে দিয়েছি। রোগী যাবে কোথায়?”