একজন পরামর্শক চিকিৎসকের অভাবে...

করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য সরকারনির্ধারিত হাসপাতালের একটি ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল। পাঁচ দিন আগে থেকে করোনাভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে আসা ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভর্তির জন্য যে আইসোলেশন ইউনিট থাকা দরকার, তা হাসপাতালটিতে নেই। নেই কোনো নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)। হাসপাতালটিতে ১৯ জন চিকিৎসকের মধ্যে সাতজন চিকিৎসক এখনো যোগ দেননি। একজন পরামর্শক চিকিৎসকের অভাবে এই হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি করা যাচ্ছে না।

ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক প্রকাশ চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য আমাদের হাসপাতালটি সরকার নির্ধারণ করেছে। ২৫ মার্চ থেকে আমাদের হাসপাতালের বহির্বিভাগে করোনাভাইরাসের রোগের লক্ষণ নিয়ে আসা ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু হয়েছে। তবে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভর্তি করার জন্য যে আইসোলেশন ইউনিট থাকা দরকার, তা এখনো চালু করতে পারিনি। কারণ, আইসোলেশন ইউনিট চালু করার জন্য পরামর্শক চিকিৎসক (কনসালট্যান্ট) দরকার হয়। কিন্তু আমাদের এখানে চিকিৎসক নেই। যদিও সরকার প্রেষণে চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছে; কিন্তু পরামর্শক চিকিৎসকসহ মোট সাতজন এখনো যোগ দেননি।’

চিকিৎসক প্রকাশ চন্দ্র রায় জানান, ‘বহির্বিভাগ চালু হলেও ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালে অন্তর্বিভাগ এখন পর্যন্ত পুরোপুরি চালু করা যায়নি। এর অন্যতম কারণ চিকিৎসকসংকট। হাসপাতালে সব ধরনের সেবা চালু করার জন্য সব ধরনের মেডিকেল সরঞ্জাম থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের এখানে সব ধরনের মেডিকেল সরঞ্জাম নেই। হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) চালু করা যায়নি। নেই ভেন্টিলেশনও। এসব মেডিকেল সরঞ্জাম পেলে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে পুরোপুরি সেবা চালু করা সম্ভব হবে।’

ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক প্রকাশ চন্দ্র রায়। ছবি: আসাদুজ্জামান
ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক প্রকাশ চন্দ্র রায়। ছবি: আসাদুজ্জামান



চিকিৎসক যোগ দিচ্ছেন না
পুরান ঢাকার বাবুবাজার এলাকার বুড়িগঙ্গা সেতুর ডানে তিনতলাবিশিষ্ট ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালটির অবস্থান। হাসপাতালটি ১৫০ শয্যাবিশিষ্ট। হাসপাতালটির পরিচালক প্রকাশ চন্দ্র জানান, চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য তাঁদের প্রতিষ্ঠানটি নির্বাচিত করা হয়। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে ৩৩ জন নার্স এবং ১৯ জন চিকিৎসক প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত ৩৩ জন নার্সের মধ্যে ২১ জন নার্স তাঁদের হাসপাতালটিতে যোগদান করেছেন। আর ১৯ জন চিকিৎসকের মধ্যে ১২ জন চিকিৎসক যোগ দিয়েছেন। কিন্তু সাতজন চিকিৎসক তাঁদের হাসপাতালে যোগ দেননি। এ বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে।

ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেল, হাসপাতালটির প্রধান ফটকের সামনে কাচঘেরা কক্ষে বসে ছিলেন একজন নিরাপত্তারক্ষী। তাঁর পরনে ছিল পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই)। হাসপাতালটির তৃতীয় তলার কেবিনসহ সাধারণ বেডগুলো পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি।

করোনার লক্ষণ নিয়ে আসা ব্যক্তিরা চিকিৎসাসেবা নিতে আসার কারণে হাসপাতালটির কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে। প্রকাশ চন্দ্র রায় বলেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক সবার মধ্যে আছে। ডাক্তারদের মধ্যেও আতঙ্ক আছে। তবে আমরা আমাদের হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সেমিনারে বলেছি, এটা একটা ন্যাশনাল ক্রাইসিস। ঘরে বসে থাকলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে না তা নিশ্চিত নয়। এ দুর্যোগের মুহূর্তে আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। আগে যে ধরনের ভীতি ছিল, তা এখন নেই।’

হাসপাতালের সামনে পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) পরে দায়িত্ব পালন করছেন এক ব্যক্তি। ছবি: আসাদুজ্জামান
হাসপাতালের সামনে পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) পরে দায়িত্ব পালন করছেন এক ব্যক্তি। ছবি: আসাদুজ্জামান

প্রকাশ চন্দ্র রায় জানান, ‘পরামর্শক চিকিৎসক না থাকায় হাসপাতালে পুরোপুরি সেবা চালু করা যাচ্ছে না। ঢাকার মুগদা হাসপাতালের চিকিৎসক নিরুপম কুমার দাসকে তাঁদের হাসপাতালের পরামর্শক চিকিৎসক হিসেবে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়। এখনো তিনি যোগদান করেননি। তাঁকে ফোন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফোন ধরছেন না। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে। পরামর্শক চিকিৎসক না পাওয়া পর্যন্ত আইসোলেশন ইউনিট করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।’

রোগীদের মধ্যে করোনাভীতি
ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পাঁচ দিন ধরে জ্বর, সর্দি, কাশিসহ করোনাভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসছেন। এখন পর্যন্ত তিনজনকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহ করেন প্রতিষ্ঠানটির চিকিৎসকেরা।

প্রকাশ চন্দ্র বলেন, ‘করোনার লক্ষণ নিয়ে প্রতিদিনই আমাদের কাছে রোগী আসছে। আমরা বহির্বিভাগে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি। এদের মধ্যে তিনজনকে আমরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে জোর সন্দেহ করি। পরে তাঁদের সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। যারা আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসছে, তাদের মধ্যে একধরনের ভীতি কাজ করছে। আমরা তাদের বারবারই বলছি, আপনারা ভীত হবেন না। ভয় আপনার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দেবে।’

করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার নির্ধারিত একটি হাসপাতাল ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল। ছবি: আসাদুজ্জামান
করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার নির্ধারিত একটি হাসপাতাল ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতাল। ছবি: আসাদুজ্জামান

ঢাকা মহানগর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক কাকলি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের আউটডোর (বহির্বিভাগ) চালু হয়েছে। যাঁরা আমাদের হাসপাতালে আসছেন, তাঁরা অধিকাংশ জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথায় আক্রান্ত। রোগীদের মধ্যে খুবই আতঙ্ক দেখছি। সর্দি, জ্বর হলেই লোকে ভাবছেন, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মানসিকভাবে ভয় পাচ্ছেন বেশি। অবশ্যই আমরা তাঁদের মনোবল বাড়ানোর জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। জ্বর, সর্দি, কাশির জন্য চিকিৎসা দিচ্ছেন। তাঁদের প্রত্যেককে ১৪ দিন সেলফ কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হচ্ছে। আমাদের সবার মধ্যে আতঙ্ক আছে।’


করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় সব ধরনের সেবা কবে নাগাদ চালু হবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো দিন-তারিখ জানাতে পারেননি হাসপাতালটির পরিচালক প্রকাশ চন্দ্র। তিনি বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সব ধরনের সেবা চালু করার জন্য পরিপূর্ণ সব সরঞ্জাম দরকার। যতক্ষণ না সবকিছু পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ আমরা রোগীকে ভর্তি করতে পারছি না। দেওয়া যাচ্ছে না সব ধরনের সেবা।’