এই মানুষগুলো বাঁচবে কেমনে

জয়া সিকদার।
জয়া সিকদার।

জয়া সিকদার বললেন, ‘অবস্থার কি আর শেষ আছে? ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়া কমিউনিটির সেক্সওয়ার্কারদের দেখলেই মানুষ বলে, তোরাই করোনাভাইরাস, তোরাই এই ভাইরাস ছড়াচ্ছিস।’ মানুষের বাড়ির দরজা বন্ধ, পথে মানুষ নেই। এই কমিউনিটির মানুষের কাজ নেই। হাতে পয়সা নেই। খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।

জয়া সিকদার একজন লিঙ্গ–রূপান্তরিত নারী। জয় থেকে জয়া হওয়ার কারণে মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাড়ির বাইরে পা রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। বর্তমানে বয়স প্রায় ৪৫ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে নিজে নানা নির্যাতন সহ্য করে, সংগ্রাম করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আর বর্তমানে সংগ্রাম করছেন লিঙ্গবৈচিত্র্যের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে। ২০১০ সালে সম্পর্কের নয়া সেতু নামের সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তিনি এ সংগঠনের প্রেসিডেন্ট। এ সংগঠন থেকে সরাসরি উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ৫০০।

জয়া সিকদার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মানুষ মানুষের জন্য। এখন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টিকে থাকার বড় প্রশ্ন সবার কাছে। সবাই বলে সেভ থাকবেন বাসায় থাকবেন, ঘরের বাইরে কোথাও যাবেন না। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে অবহেলিত মানুষ, ভাসমান ট্রান্সজেন্ডার, সেক্সওয়ার্কার সুমি, নদী, রূপালী, বিপাশা, মনীষা, কাজল, শান্ত ওরা যখন ফোন করে আমাকে বলে...এখন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সবই বন্ধ, তাইলে আমরা কেমনে বাঁচুম আর কী খামু। আপনে আমাগোরে বিষ দেন। বিষ খাইয়া মইরা যাই আপা। এই কথাগুলো শুনার পর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।’

জয়া সিকদার বলেন, হিজড়া একটি ট্র্যাডিশন বা সংস্কৃতি। ২০১৩ সালে সরকার হিজড়া হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তবে হিজড়া সংস্কৃতি লালন করা বা লিঙ্গ–রূপান্তরিত মানুষগুলোর জীবনে এ স্বীকৃতির প্রভাব তেমনভাবে পড়েনি। চাকরি পাওয়া থেকে শুরু করে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেনি। বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে সরকার ৫০০ টাকা করে ভাতা দিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে শিক্ষাবৃত্তি।

জয়া বলেন, এই কমিউনিটির বেশির ভাগ সদস্য ১১-১২ বছর বয়সে পরিবার ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। পড়াশোনা বেশি দূর করতে পারেননি। রাজধানীতে এই কমিউনিটির অনেকেই মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করে বা বাড়িতে গিয়ে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করে। এ ছাড়া তারা করবেটা কী? বাঁচতে তো হবে। এসব কারণে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হন, তাও ঠিক আছে। কিন্তু এই কমিউনিটির সবাই তো আর খারাপ না বা তারা খারাপ কাজটা কেন করছে, তাও তো বুঝতে হবে। অন্যদিকে করোনাভাইরাস বিস্তারে পুরো বিশ্ব যেখানে দিশেহারা, সমাধানের কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে এই কমিউনিটির ঘাড়েই করোনাভাইরাস ছড়ানোর অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে, যা খুবই কষ্টকর।

জয়া বলেন, রাস্তা বা বাড়ি থেকে যাঁরা টাকা তোলেন, সে টাকার অর্ধেক দিতে হয় গুরুকে, অন্যান্য ভাগবাঁটোয়ারার হিসাব আছে। বাকি যা থাকে, সে টাকায় নিজের খাওয়া-পরা ম্যানেজ করতে হয়। ফলে এই মানুষগুলোর সঞ্চয় বলে কিছু থাকে না। এই কমিউনিটির যারা যৌন পেশার সঙ্গে যুক্ত, করোনাভাইরাসের আতঙ্কে সে কাজও বন্ধ। এই মানুষগুলোর সহায়তায় এখন পর্যন্ত বড় কোনো উদ্যোগও নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের একটি দল, ব্যক্তি উদ্যোগের কিছু সহায়তায় এই মানুষগুলো টিকে আছে, কত দিন টিকে থাকতে পারবে, তা অনিশ্চিত।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছেন জয়া। তবে বেসরকারি সংগঠন কেয়ার বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পান। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের সঙ্গে এইচআইভি এইডস প্রতিরোধে কাজ করেন। বর্তমানে উন্নয়নকর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। কমিউনিটিকে নিয়ে কথা বলার জন্য দেশ–বিদেশের সভা-সেমিনারে অংশ নেন। বিভিন্ন সম্মানী ভাতা পান।

জয়া বললেন, ‘এইচআইভি এইডস প্রতিরোধে কাজ করতে গিয়ে ভয় লাগেনি। কিন্তু এখন করোনা নিয়ে আমি নিজেও ভয়ে ঘরবন্দী। সবাই আতঙ্কে আছি। বড় চাকরিজীবীরা ঘরে ছুটি কাটালেও মাসের বেতন পাবেন, কিন্তু আমার কমিউনিটির মানুষের সে সুযোগ নেই। কেউ যদি এখন অসুস্থ হয়, চিকিৎসা পাওয়াটাও বড় সমস্যা হবে। সমাজে যখন স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে, তখন এই কমিউনিটির কেউ হাসপাতালে গেলে তাকে নারী না পুরুষ কোন ওয়ার্ডে ভর্তি করবে, সে ফয়সালা করতেই তো সময় অনেক পার হয়ে যায়। আর এখন তো অবস্থা ভয়াবহ। সরকারের হিসাবে কম হলেও আমাদের হিসাবে ঢাকা শহরেই এই কমিউনিটির মানুষের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। অন্য নিম্ন আয়সহ বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের অনেকেই গ্রামে চলে গেছেন, কিন্তু আমাদের কমিউনিটির বেশির ভাগ সদস্যের সে উপায়ও নেই। পরিবার-সমাজ তো এই মানুষগুলোকে গ্রহণ করবে না।’

জয়া সিকদার কমিউনিটির মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। যে যা পারেন, তাই দিয়ে সাহায্য করার কথা বলেছেন। সাহায্য পাঠানোর জন্য ফোন নম্বর 01718512512।

বিকাশ নম্বর 01718512512 এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট PUBALI BANK LIMITED, Asad Avenue Name: SOMPORKER NOYA SETU, Account Number: 2706101077756 এ যোগাযোগ করা যাবে।

জয়া বললেন, ‘এই দুর্যোগের সময়ও সাহায্যের আবেদনে আমাদের গালি দিচ্ছেন অনেকে। রাস্তায় কে বাজে ব্যবহার করেছে, তা উল্লেখ করে বলছেন, আমাদের সাহায্য দিয়ে লাভ নেই। ভালোমন্দ তো সব মানুষের মধ্যেই আছে।’