সিলেট শহরের কোথাও ভিড়, কোথাও ফাঁকা

করোনার প্রভাবে কয়েক দিন সিলেট শহরে মানুষজনের উপস্থিতি কম ছিল। আবারও বাড়ছে মানুষজন ও যানবাহনের চাপ। ছবিটি গতকাল মঙ্গলবার সিলেট নগরের বন্দরবাজার থেকে সকালে তোলা। ছবি: আনিস মাহমুদ
করোনার প্রভাবে কয়েক দিন সিলেট শহরে মানুষজনের উপস্থিতি কম ছিল। আবারও বাড়ছে মানুষজন ও যানবাহনের চাপ। ছবিটি গতকাল মঙ্গলবার সিলেট নগরের বন্দরবাজার থেকে সকালে তোলা। ছবি: আনিস মাহমুদ

সিলেট নগরের বুক চিরে বয়ে গেছে সুরমা নদী। চৈত্র মাস হওয়ায় নদীর পানি অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। সামান্য পানিতেই হৈ-হুল্লোড় আর দাপাদাপি করে গোসল সেরে নিচ্ছে একদল দুরন্ত শিশু-কিশোর। একটু দূরেই পাশাপাশি দূরত্বে দাঁড়িয়ে-বসে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করছেন কয়েকজন। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টায় এ দৃশ্য দেখা গেছে নদীপাড়ে অবস্থিত নগরের ঝালোপাড়া এলাকায়।

®ঝালোপাড়া এলাকার মতো গতকাল নগর ও শহরতলির বেশ কয়েকটি এলাকায় সামাজিক দূরত্ব না মেনে মানুষজনকে বাইরে অযথা ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। শিশু, তরুণ, যুবক ও প্রবীণ—সব বয়সী মানুষকেই নগরের বিভিন্ন এলাকায় আড্ডারত অবস্থায় পাওয়া গেছে। অথচ সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কাউকে বাসার বাইরে না বেরোতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। নগরের বেশ কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, কিছু এলাকা বাদে তুলনামূলকভাবে কমসংখ্যক মানুষই বাসার বাইরে বের হচ্ছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরের আম্বরখানা ও বন্দরবাজার এলাকায় যানবাহনের অবাধ চলাচল ছিল। রিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ি, কাভার্ডভ্যান, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ঠেলাগাড়িসহ নানা ধরনের যান যাত্রী ও পণ্য নিয়ে চলাচল করেছে। তবে এর বাইরে অন্যান্য এলাকায় খুব বেশি যানবাহনের চলাচল দেখা যায়নি। যানবাহন চলাচল না করলেও বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে তরুণ-যুবকদের দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে দেখা গেছে। শিশুদের রাস্তায় খেলতে দেখা গেছে। দল বেঁধে হাঁটতে দেখা গেছে বয়স্কদেরও।

নগরের বাগবাড়ি, করেরপাড়া, আখালিয়া, পনিটুলা, কালীবাড়ি, হাওলদারপাড়া, নয়াবাজার, বনকলাপাড়া, উপশহর, শিবগঞ্জ ও বালুচর এলাকার বিভিন্ন মহল্লার রাস্তায় দাঁড়িয়ে তরুণ-যুবকদের আড্ডা দিতে দেখা গেছে। তবে এসব এলাকার মূল সড়কগুলো ছিল অনেকটাই ফাঁকা, সুনশান। কতক্ষণ পর পর কেবল দু-একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রিকশা এসব রাস্তা দিয়ে যাওয়া-আসা করছিল। বেলা দেড়টায় শহরতলির টুকেরবাজার এলাকায় দেখা গেছে, সবজি ব্যবসায়ীরা অনেকটা পাশাপাশি বসেই নিজেদের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। কারও মুখে মাস্ক কিংবা হাতে গ্লাভস ছিল না। ক্রেতাদেরও উপস্থিতি ছিল না। মাত্র দুজন ক্রেতাকে সেখানে সবজি কিনতে দেখা গেছে।

বেলা পৌনে তিনটার দিকে মদিনা মার্কেট গিয়ে দেখা গেছে, সবজি ও মুদি দোকানে অনেক ক্রেতাই এসেছেন। অনেকের মুখে মাস্ক। বিক্রেতাদের অনেকের হাতে গ্লাভস আছে। তবে কাউকেই দূরত্ব বজায় রেখে কেনাবেচা করতে দেখা যায়নি। প্রায় সবাই একে অপরের শরীর ঘেঁষে কেনাকাটা সারছিলেন। নগরের বাগবাড়ি এলাকার আমিনুর রহমান (৪৩) নামের এক ক্রেতা বলেন, 'ঘরে সবজি নেই। তাই কিনতে বের হয়েছি। আর মুদির দোকানে টুকটাক কিছু বাজার করেছি। এখন ঘরে ফিরে যাব।'

করোনাভাইরাসের এ সময়ে কোনো নিয়ম–নীতি না মেনে নদীতে গোসল করছে দুরন্ত শিশু-কিশোরের দল। ছবিটি গতকাল মঙ্গলবার সিলেট নগরের ‍সুরমা নদীর ঝালোপাড়া এলাকা থেকে তোলা। ছবি: আনিস মাহমুদ
করোনাভাইরাসের এ সময়ে কোনো নিয়ম–নীতি না মেনে নদীতে গোসল করছে দুরন্ত শিশু-কিশোরের দল। ছবিটি গতকাল মঙ্গলবার সিলেট নগরের ‍সুরমা নদীর ঝালোপাড়া এলাকা থেকে তোলা। ছবি: আনিস মাহমুদ

মদিনা মার্কেটের সবজি ও মুদি দোকানিরা জানান, যতটা সম্ভব ক্রেতার সঙ্গে দূরত্ব রেখে তাঁরা কেনাবেচা করছেন। তবে আগের তুলনায় বেচাকেনা অর্ধেকেরও কম হচ্ছে। কবে যে এই সংকটের অবসান হবে, সে চিন্তায় রয়েছেন তাঁরা।

মদিনামার্কেট এলাকায় তিনজন পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিকে রাস্তায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গল্প করতে দেখা যায়। রশিদ আহমদ নামের তাদের একজন বলেন, 'বেশ কয়েক দিন ঘরে অনেকটা বন্দীর মতো ছিলাম। বাসার বাইরে বের হয়েছি প্রয়োজনীয় কিছু বাজার করতে। এসে দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা। অনেক দিন পর তাদের সামনাসামনি পেয়ে কিছু গল্পগুজব করছি।'

কালীবাড়ি এলাকায় কথা হয় রিকশাচালক তোতা মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, 'রিকশা চালাইয়া যে ট্যাকা পাই, তাই দিয়া চাউল-ডাল কিনি। ঘর থাকি না বার অইলে খাইমু কিতা?' তিনি সকাল ১০টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত তিনি আয় করেছেন মাত্র ৩০ টাকা। অথচ এ সময়ের মধ্যে তাঁর কয়েক শ টাকা আয় হয় স্বাভাবিক সময়ে।

বেলা সোয়া তিনটার দিকে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেন হাওলদারপাড়া এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী সুজিত দাশ। তিনি বলেন, 'গত সোমবার বাসার বাইরে নগরের দু-একটি এলাকায় জরুরি প্রয়োজনে গিয়েছিলাম। দেখি, সব এলাকা চুপচাপ ও সুনশান। কোথাও ভিড় ছিল, আবার কোথাও ছিল একেবারেই ফাঁকা। তবে টিভিতে দেশের অন্যান্য এলাকার যে খবর দেখি, তার তুলনায় সিলেটে মানুষ কমই বাসা থেকে বের হচ্ছেন। কয়েকটা দিন এভাবে ঘরবন্দী হয়ে কাটাতে পারলে হয়তো করোনার সংকট থেকে আমরা উদ্ধার পাব! কবে যে এই দুর্বিষহ দিনের শেষ হবে, সবাই এটাই ভাবছি।'