পানির দরে দুধ বিক্রি, দুর্দশায় খামারিরা

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিপাকে পড়েছেন দুগ্ধ খামারিরা। হোটেল ও চায়ের দোকান বন্ধ। দুধ কিনছে না সাধারণ মানুষও। ফলে পানির দামেও দুধ বিক্রি করতে পারছেন না খামারিরা। গতকাল পাবনার টেবুনিয়া হাটে।  ছবি: হাসান মাহমুদ
করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিপাকে পড়েছেন দুগ্ধ খামারিরা। হোটেল ও চায়ের দোকান বন্ধ। দুধ কিনছে না সাধারণ মানুষও। ফলে পানির দামেও দুধ বিক্রি করতে পারছেন না খামারিরা। গতকাল পাবনার টেবুনিয়া হাটে। ছবি: হাসান মাহমুদ

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী প্রামাণিকপাড়া গ্রামে রয়েছেন ২৫ জন দুগ্ধ খামারি। তাঁদের নিয়ে গড়ে উঠেছে বাঘাবাড়ী মিল্ক ভিটার আওতাভুক্ত প্রামাণিকপাড়া প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতি। করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার আগে সমিতির সদস্যরা সকাল–বিকেল মিলিয়ে মিল্ক ভিটায় ৩৪০ লিটার দুধ দিতেন। প্রতি লিটার ৪০ থেকে ৪২ টাকা দরে। এখন সেখানে মিল্ক ভিটার কাছে তাঁরা কেবল ৮০ লিটার দুধই বেচতে পারেন। বাকি দুধ খোলাবাজারে ১৫ থেকে ১৬ টাকা লিটার দরে বিক্রি করছেন। কখনো কখনো এই দামেও দুধ নেওয়ার ক্রেতা পাচ্ছেন না তাঁরা।

প্রামাণিকপাড়ার এ খামারিদের মতো অবস্থা পাবনা ও সিরাজগঞ্জের অন্য খামারিদেরও। করোনাভাইরাসের প্রভাবে দুধের চাহিদা একেবারেই পড়ে যাওয়ায় খামারিরা পানির দরে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কোথাও দুধ ফেলেও দিতে হচ্ছে। তবে অনেক খামারিই এখন দুধ থেকে ননি তুলে রেখে ক্ষতি কিছুটা কমাচ্ছেন। এ পদ্ধতিতে ননি তুলে রাখে বাকি দুধ ফেলে দেওয়া হচ্ছে।

 পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া দেশের প্রধান গরুর দুধ উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবে বিবেচিত। প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ এলাকার ২৫ হাজারের বেশি খামারে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ লিটার গরুর দুধ উৎপাদিত হয়। প্রচুর দুধ উৎপাদিত হওয়ায় এ এলাকা থেকে মিল্ক ভিটা, আড়ং দুধ, প্রাণ ডেইরি, ফার্মফ্রেশ, অ্যামোমিল্ক, আফতাব, রংপুর ডেইরিসহ কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান তরল দুধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে সারা দেশে খোলাবাজারে বিক্রি করে থাকে।

প্রামাণিকপাড়া দুগ্ধ সমবায় সমিতির সভাপতি কেসমত আলী বলেন, ‘গরুর খাদ্যের দাম কয়েক দিনে বাইড়্যা যাওয়ায় এমনিতেই আমরা কাহিল। এর ওপর দুধ বেচার জায়গা নাই। করোনা নামের রোগে পথের ফকির হয়া যাতেছি আমরা।’

 খামারিরা বলছেন, দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই খামারিদের দুধ বিক্রির প্রধান জায়গা। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ নেওয়া একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান এই সুযোগে কম দামে দুধ কেনার চেষ্টা করছে। তা–ও তাঁদের তালিকাভুক্ত খামারি ছাড়া অন্যরা সেখানেও বেচতে পারছেন না। লোকজন ঢাকা শহর ছাড়ায় সেখানে দুধ প্রায় চলছেই না। পাবনা ও সিরাজগঞ্জের বেশির ভাগ ছানা, ঘি ও মিষ্টি তৈরির কারখানা বন্ধ।

তবে মিল্ক ভিটার বাঘাবাড়ী কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক ইদ্রিস আলীর দাবি, তাঁরা দুধ সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছেন। আর প্রাণের প্রধান ডেইরি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাকিবুর রহমান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁরা দুধ সংগ্রহ না কমিয়ে বরং বাড়িয়েছেন। তবে এ জন্য খামারিদের প্রচণ্ড চাপ তাঁদের সহ্য করতে হচ্ছে। বাড়তি দুধ গুঁড়া দুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, খামারিদের কম দাম নয়, আগের দামই দেওয়া হচ্ছে।

গতকাল বুধবার সাঁথিয়া উপজেলার আমাইকোলা গ্রামের একটি ছানা ও ননি তৈরির কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে খামারিরা দুধ বিক্রি করতে এসেছেন। কারখানার মালিক ওয়াজেদ আলী ২০ টাকা লিটার দরে ৬০০ লিটার দুধ সংগ্রহ করে রাখার পর বাকি দুধ ফিরিয়ে দেন। ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘খামারিদের লোকসান থেকে বাঁচাতে কারখানাটি খুলে রেখেছি। যতটুকু পারছি দুধ নিয়ে তা থেকে ননি তুলে ফেলছি। আগে ননিবিহীন দুধ ১০ থেকে ১৫ টাকা লিটার দরে বিক্রি হতো। এখন বিনা পয়সায় নেওয়ারও কেউ নাই, ফেলে দিতে হচ্ছে।’

 ওই কারখানায় দুধ দিতে না পেরে খামারি ফারুক হোসেন হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার সময় বলেন, ‘এই জায়গায় তা-ও প্রতি লিটারের দাম ২০ টাকা পাওয়া যায়। বাজারে নিলি ১৫ টাকা পাওয়া যাবি কি না সন্দেহ।’