আপাতত বড় ছেলের কাছে ঠাঁই হলো মায়ের

ব্যবহারের জিনিসপত্র বস্তায় ভরে ভ্যানে করে বিচারের আশায় বাড়ি থেকে বের হন বৃদ্ধা বুঞ্জনী বেওয়া। গড়মাটি বাজার এলাকা, বড়াইগ্রাম, নাটোর, ২ এপ্রিল। ছবি: মুক্তার হোসেন
ব্যবহারের জিনিসপত্র বস্তায় ভরে ভ্যানে করে বিচারের আশায় বাড়ি থেকে বের হন বৃদ্ধা বুঞ্জনী বেওয়া। গড়মাটি বাজার এলাকা, বড়াইগ্রাম, নাটোর, ২ এপ্রিল। ছবি: মুক্তার হোসেন

ব্যবহারের জিনিসপত্র বস্তায় ভরে বিচারের আশায় ভ্যান চেপে গ্রামের দফাদারের বাড়িতে যান ৮০ বছরের বৃদ্ধা বুঞ্জনী বেওয়া। দফাদার ইয়াসিন আলী ভ্যানভাড়া পরিশোধ করে তাঁর কাছে সমস্যার কথা জানতে চান।

বৃদ্ধার অভিযোগ, তাঁর সাত ছেলে ও এক মেয়ে। কেউ তাঁকে ভাত-কাপড় দেন না। বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। তিনি বিচার চান। বিচার করার ক্ষমতা তাঁর নেই জানিয়ে দফাদার তাঁকে নিয়ে গেলেন গ্রামের মাতবর বাবুল হোসেনের দোকানে। তিনি সবকিছু শুনে জানালেন, এই বিচার করার ক্ষমতা তাঁরও নেই। মুঠোফোনে খবর দিলেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে চেয়ারম্যান এলেন।

ওই নারীর অভিযোগ শুনে উপজেলা চেয়ারম্যান বললেন, ছেলেদের শায়েস্তা করতে হলে বিচারিক ক্ষমতা দরকার। সেখানে দাঁড়িয়ে খবর দিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও)। তিনিও এলেন। সবকিছু শোনার পর তিনি বিচার করার আশ্বাস দিলেন। ১১ এপ্রিল সাত ছেলে ও তাঁদের বউদের তাঁর কার্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিলেন। করোনাভাইরাসের কথা বলে তত দিন পর্যন্ত বড় ছেলের কাছে মাকে জিম্মায় রেখে চলে গেলেন। এ কয় দিনের খরচের টাকাও তুলে দেন তিনি। আজ বৃহস্পতিবার নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার গড়মাটি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

বুঞ্জনী বেওয়া বড়াইগ্রামের গোপালপুর ইউনিয়নের গড়মাটি গ্রামের মৃত হাজির উদ্দিন প্রামাণিকের স্ত্রী। গ্রামের মাতবর বাবুল হোসেন বলেন, হাজির উদ্দিন সচ্ছল মানুষ ছিলেন। তাঁর প্রায় ৩২ বিঘা জমি ছিল। স্ত্রী বুঞ্জনী বেওয়ার নামেও ছিল ১২ বিঘা জমি। প্রায় আট বছর আগে হাজির মারা যান। বিধবা স্ত্রী স্বামীর রেখে যাওয়া একটি ঘরে বসবাস করতেন। জমি–জায়গা বর্গা দিয়ে যা আসত, তা দিয়ে ভালোই চলত। বছর না ঘুরতে সাত ছেলে বাবার জমি ভাগাভাগি করে আলাদা হয়ে যান। মেয়ের বিয়ে হওয়ায় শ্বশুরবাড়িতে চলে যান। তবু বুঞ্জনী বেওয়ার সময়টা ভালোই কাটছিল। তবে কয়েক বছর যেতেই ছেলেমেয়েরা নানা প্রলোভনে তাঁর সব জমি নিজেদের নামে রেজিস্ট্রি করে নেন। থাকার একমাত্র ঘরটিও পঞ্চম ছেলে শহিদুল দখল করে নেন। তিনি পুরোপুরি ছেলেদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ভাত–কাপড়ে টান পড়ে। বয়সের ভারে চলতে পারেন না। এক ছেলের বাড়িতে সপ্তাহ না যেতেই তাঁকে অন্য ছেলের বাড়িতে ঠেলে দেওয়া হয়। সবশেষে আজ সকাল ৯টার দিকে চতুর্থ ছেলে লুৎফর রহমান তাঁর মাকে সাফ জানিয়ে দেন, তাঁকে খাওয়ানোর মতো খাবার তাঁর ঘরে নেই। তিনি একটা ভ্যান ডেকে ব্যবহারের কিছু জিনিসপত্রসহ তাঁর মাকে গ্রামের দফাদার ইয়াসিন আলীর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।

ইয়াসিন আলী বলেন, ‘বুঞ্জনী বেওয়ার সব ছেলেমেয়ে মোটামুটি শিক্ষিত ও সচ্ছল। বড় ছেলে মতিউর রহমান গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। অন্যরা ব্যবসা ও কৃষিকাজ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। অথচ বৃদ্ধার মুখে তিন বেলা খাবার জোটে না। পরনের কাপড়, ওষুধ কেনার টাকা চাইতে হয় অন্যের কাছে।’

বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে বুঞ্জনী বেওয়ার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিনিধির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সব জমি ফিরে চাই। জমি না থাকায় ওরা আমাকে ভাত দেয় না। মরে গেলে তো ওই জমি ওরাই পাবি।’

এ বিষয়ে বড় ছেলে মতিউর রহমান বলেন, মায়ের সম্পত্তি শেষ হওয়ার পর ভাই ও তাদের বউরা ভাত–কাপড় দেওয়া নিয়ে পরস্পরের মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু করেছেন। এ কারণে মা বিচারের আশায় বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। পালা করে ভরণপোষণের দায়িত্ব দিলে তিনি তা পালন করবেন। অন্য ভাইয়েরা তা মানবেন কি না, তা নিয়ে তিনি পারিবারিক সভা করবেন বলে জানান।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইউএনও আনোয়ার পারভেজ বলেন, ‘ঘটনাটি মর্মস্পর্শী। শেষ পর্যন্ত করোনার ভয় দেখিয়ে বড় ছেলের কাছে মাকে রেখে আসা হয়েছে। সমস্যা সমাধানের জন্য সবাইকে ডাকা হয়েছে। সমাধান না করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

উপজেলা চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা ভাত-কাপড় দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে বৃদ্ধার সব জমি নিয়ে নিয়েছে। এমনকি শোয়ার ঘরটিও এক ছেলে দখল করে নিয়েছে। এদের অবশ্যই বিচার করা হবে।’