তাবলিগের ৪৯৮ বিদেশি সদস্য আটকা পড়েছেন

মার্চে দিল্লির নিজামউদ্দিনে তাবলিগ জামাতে দেশ-বিদেশের হাজারো মুসল্লি অংশ নেন। রয়টার্স ফাইল ছবি
মার্চে দিল্লির নিজামউদ্দিনে তাবলিগ জামাতে দেশ-বিদেশের হাজারো মুসল্লি অংশ নেন। রয়টার্স ফাইল ছবি

৩১ মার্চের সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। কাকরাইলের ঐতিহ্যবাহী মসজিদের প্রধান ফটক। ভেতরে সুনসান নীরবতা। ভেতরে দেড় শ বিদেশি তাবলিগ সদস্য। সারা দেশে এভাবে মোট আটকা পড়েছেন ৪৯৮ বিদেশি। তাঁদের অনেকেই মধ্য জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশে আছেন। ইতিমধ্যে এটা নিশ্চিত যে গত দেড়-দুই মাসে দিল্লি, জাকার্তা, লাহোর ও কুয়ালালামপুরে তাবলিগ সমাবেশ থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে এবং এ–সংশ্লিষ্ট এ পর্যন্ত অন্তত ১০ জনের মৃত্যু ঘটেছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস জানায়, ভারতের দিল্লির নিজামুদ্দিন এলাকায় তাবলিগ জামাতে অংশ নেওয়া তিন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। হরিয়ানা রাজ্যের পলওয়াল জেলার প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ব্রাহ্মণ দ্বীপ সিন্ধু এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, আক্রান্ত তিনজনেরই বয়স ত্রিশের কোঠায়। তাঁদের সিভিল হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে।

 গত ডিসেম্বরে উহানে করোনাভাইরাস ছড়ানোর পরে মধ্য জানুয়ারিতে টঙ্গীতে দুই দফায় (সাদবিরোধীরা ১০-১২ জানুয়ারি এবং সাদপন্থীরা ১৭-১৯) বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা সাদবিরোধীদের দাবি, টঙ্গীতে জানুয়ারিতে তাঁদের পক্ষে ৮০টি দেশের প্রায় আড়াই হাজার এবং সাদপন্থীদের মতে, ৬১টি দেশ থেকে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি তাবলিগ সদস্য এসেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন। এরপর বাংলাদেশি তাবলিগ জামাতের অনেক সদস্য দিল্লি, জাকার্তা, লাহোর ও কুয়ালালামপুরে তাবলিগ সমাবেশে অংশ নেন। ২০১৭ সালে মতাদর্শগত কারণে তাবলিগ বিভক্ত হয়। উভয় অংশের নেতাদের দাবি, বাংলাদেশে অবস্থানরত দুই পক্ষের অনুসারী প্রায় ৫০০ বিদেশি তাবলিগ সদস্যের (দিল্লির নিজামউদ্দিন মারকাজের প্রধান মাওলানা মো. সাদ কান্ধলভীর অনুসারী ৩৪১ এবং তাঁর বিরোধী আদর্শের ১৫৭ জন) সবাই সুস্থ আছেন।

উল্লেখ্য, ভারত মঙ্গলবার বলেছে, দিল্লির নিজামউদ্দিন মারকাজের (তাবলিগের প্রধান দপ্তর) সমাবেশে আসা ইন্দোনেশীয় তাবলিগ সদস্যদের মাধ্যমে ভারতের বহু রাজ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। এর ফলে তেলেঙ্গানা রাজ্যে ৬ জন এবং কাশ্মীরে ১ জনের মৃত্যু ঘটেছে। ঢাকায় সাদ–অনুসারী পক্ষের একজন মুখপাত্র অবশ্য গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, এই তথ্য সঠিক নয়। এটা অপপ্রচার। আবার তাঁর বিরোধী পক্ষের একজন মুখপাত্র নিজামউদ্দিন মারকাজের বন্ধ করা এবং সাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরে ভারতের আইনি পদক্ষেপকে সমর্থন করেন। উভয় পক্ষের মুখপাত্র তাঁদের নাম প্রকাশ করতে চাননি। তাঁরা একমত, বিদেশি অতিথিরা বাংলাদেশে আটকে পড়েছেন বলে তাঁদের অবস্থানকে নেতিবাচকভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তাঁরা বলেন, তাঁরা কেউ অসুস্থ হননি বলেই তাঁদের করোনা পরীক্ষার দরকার পড়েনি।

>

২৫ দেশের নাগরিক মধ্য জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশে। বিভিন্ন তাবলিগ সমাবেশ থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ।

উল্লেখ্য, ১৩ মার্চ লাহোরে এবং ১৮ মার্চ একটি ইন্দোনেশীয় দ্বীপে তাবলিগ জামাতের সমাবেশ অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো তা বাতিল করে। কিন্তু দুই জায়গাতেই বাংলাদেশিসহ বিদেশিরা জড়ো হন। সাদবিরোধীদের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা থেকে লাহোরে গিয়েছিলেন। সাদবিরোধী পক্ষের মুখপাত্র গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশে প্রায় ৫ হাজার গ্রুপে সফরে থাকা ৫০ হাজারের বেশি সদস্যকে ১৬ মার্চ বাড়ি ফিরতে বলা হয়। সাদপন্থী গ্রুপের লোকজনও সারা দেশে ছড়িয়ে ছিলেন। সরকারি ঘোষণার পরে তাঁদের হঠাৎ বাড়ি ফিরতে বলা হয়। আলোচ্য ৫০০ বিদেশি মধ্য মার্চ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থান সফর করে বেড়াচ্ছিলেন।

ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন জৈন ৩১ মার্চ এনডিটিভিকে বলেন, দিল্লিতে তাবলিগ জামাতের ২৪ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। একই দিন দ্য হিন্দুর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০ দিন আগেই (২১ মার্চ) ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব রাজ্যকে চিঠি দিয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সফররত তাবলিগ জামাতের ৮২৪ জন বিদেশি সদস্যকে ‘শনাক্ত, পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টিনের’ নির্দেশ দিয়েছে। তাঁদের সবাইকে কালোতালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কারণ, তাঁরা পর্যটকের ভিসায় ঢুকে মিশনারি কাজে নিজেদের জড়িয়েছেন।

২৮ মার্চ দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরেকটি চিঠিতে রাজ্যগুলোকে ‘বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড’ থেকে আসা তাবলিগ সদস্যদের বিষয়ে সতর্ক করেছে। কারণ, তাঁরা করোনাভাইরাসের ‘পটেনশিয়াল ক্যারিয়ার’। তাঁদের ‘পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টিন’, সম্ভব হলে বিতাড়নের পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। চিঠিতে এটাও উল্লেখ আছে যে ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ মালয়েশিয়ায় তাবলিগ সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের অনেকের করোনা ধরা পড়েছে। তাই মালয়েশিয়াফেরত ব্যক্তিদের জরুরি ভিত্তিতে পরীক্ষা করা দরকার।

দ্য হিন্দুইন্ডিয়া টুডে–এর রিপোর্ট অনুযায়ী ১-১৫ মার্চ দিল্লির নিজামউদ্দিনে তাবলিগ জামাতের সমাবেশ হয়। এতে অংশ নেওয়া ছয়জন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তেলেঙ্গানায়। নিজামউদ্দিনে সমাবেশে প্রায় ১ হাজার ৫০০ জন অংশ নিয়েছিলেন। ৯৮১ জনকে খুঁজে পাওয়া গেছে। কাশ্মীরের ‘শত শত’ ব্যক্তি ওই মারকাজে যোগ দিয়েছেন।

জনতা কারফিউর আগের দিন ২১ মার্চ জম্মু ও কাশ্মীরে একজন পজিটিভ শনাক্ত হন। এর আগে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি দিল্লি ছাড়াও আন্দামান নিকোবর দ্বীপ এবং উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ সফর করেন। ধারণা করা হয়, দিল্লিতে তিনি ইন্দোনেশীয় বা থাই সদস্যদের সংস্পর্শে আক্রান্ত হন। সড়ক, রেল ও বিমানে সফরকালে তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১৫ হাজার ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন। ৬৫ বছর বয়স্ক এই ব্যক্তির পরিবারের আটজন পজিটিভ হয়েছেন। শ্রীনগর হাসপাতালে তাঁকে চিকিৎসাদানকারী ১৪ স্বাস্থ্যকর্মীও আক্রান্ত হন। ২০ মার্চ তেলেঙ্গানা পুলিশ হায়দরাবাদে তাবলিগের ১১ সদস্যকে আটক করে। বর্তমানে তাঁরা কোয়ারেন্টিনে আছেন।

ঢাকায় তাবলিগের এক মুখপাত্র মুঠোফোনে এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন, তাবলিগের সদস্য তাঁর এক ছেলেও বর্তমানে হায়দরাবাদে আছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে হায়দরাবাদের একটি মসজিদে আছে। সেখানে পুলিশ এসে খোঁজখবর নিচ্ছে। তার একটু জ্বর ছিল, সেটা সেরে গেছে। ২৭ এপ্রিল ঢাকাগামী ফ্লাইটের টিকিট কাটা আছে। এর আগে রেল চললে তাতেই ফিরবে।’

এখন বাংলাদেশে যে ৪৯৮ বিদেশি তাবলিগ সদস্য আটকা পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে ভারতের ১৭৫, ইন্দোনেশিয়ার ১৬৩, কিরগিজস্তানের ৭৭, পাকিস্তানের ১০, সৌদি আরবের ১০, ইথিওপিয়ার ১০, ফিলিপাইনের ৯, চীনের ৭, অস্ট্রেলিয়ার ৫, নেপালের ৫, মালয়েশিয়ার ৩, মিসরের ৩, মাদাগাস্কারের ৩, ইতালির ২, তিউনিসিয়ার ২, আয়ারল্যান্ডের ১, মিয়ানমারের ১, নাইজেরিয়ার ১, থাইল্যান্ডের ৩, যুক্তরাষ্ট্রের ১, ইউক্রেনের ১, যুক্তরাজ্যের ১, সিঙ্গাপুরের ১, দক্ষিণ আফ্রিকার ১ ও দক্ষিণ কোরিয়ার ১ জন।