টিকা তৈরির জন্য পুরো বিশ্ব এক

ফেরদৌসী কাদরী
ফেরদৌসী কাদরী

নতুন করোনাভাইরাসের বিষয়ে আমি প্রথম জানতে পারি গত ডিসেম্বরের ১৭–১৮ তারিখে। শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, মানব শরীরে বসবাসকারী অণুজীবের ডিএনএ, আরএনএ (মাইক্রোবায়োম) বিষয়ে গবেষণাকাজে দুদিনের জন্য বেইজিং গিয়েছিলাম। তখন দেখেছিলাম চীনের শীর্ষস্থানীয় গবেষক ও বিজ্ঞানীরা নতুন একটি ভাইরাস নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলেন। চীনের ন্যাশনাল হেলথ কমিশন ও ক্রিস্টোপ ম্যারিওক্স লাবরেটরির জেন–উই ওয়াং ও লি–লি রেন আমাকে তাঁদের ব্যস্ততার কথা বলেছিলেন। তাঁরা ডিসেম্বরেই রোগী নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁদের গবেষণা চায়নিজ মেডিকেল জার্নাল–এ ছাপা হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর চীনের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কার্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন ভাইরাসের কথা প্রকাশ করে।

২০২০ সালে বিশ্বময় জীবন এমন গভীরভাবে বিপর্যস্ত হবে, তা ছিল কল্পনার অতীত। একটি ভাইরাস বিশ্বকে এক করে দিল। একটা বিষয় শুধু জানা গেছে, ভাইরাসটা অতি দ্রুত ছড়ায়। এর টিকাও খুব দ্রুত তৈরি হতে যাচ্ছে। প্রথম ধাপের পরীক্ষা পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনটি টিকা মানুষে ব্যবহার করে দেখা হচ্ছে। একটি যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে, একটি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে এবং অন্যটি চীনের উহানে। যাঁরা কাজগুলো করছেন, তাঁদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা আমার আছে। 

ইতিমধ্যে কিছু বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। যেমন, এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮০ শতাংশের রোগের লক্ষণ থাকে মৃদু থেকে মাঝারি অসুস্থতা। চিন্তার বিষয় বাকি ২০ শতাংশ নিয়ে। এ ক্ষেত্রে ৪–৫ শতাংশ রোগীর আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর দরকার হয়। সংক্রমণ সবার মধ্যেই হতে পারে। তবে ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সীদের মধ্যে এবং অন্য রোগ আছে এমন মানুষের ঝুঁকি বেশি। আরেকটি বিষয় হলো এই ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা। যেকোনো ফ্লুর ‘আরও ভেলু’ ১.২। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হার ২ থেকে ৩। এটা অত্যন্ত বেশি।

আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধই শ্রেয়। এর একটি হচ্ছে ‘সোশ্যাল ডিসটেন্সিং’ (সামাজিক দূরত্ব)। এ ক্ষেত্রে আমরা সমবেত হওয়া থেকে বিরত থাকছি, অন্যের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি না, অনেকে কর্মস্থলে না গিয়ে বাসায় বসে অফিসের কাজ করছি। এ ছাড়া আমরা নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস করছি, নাক–মুখ–চোখে হাত দেওয়া বন্ধ করার চেষ্টা করছি। আমরা রোগীর কাছে যাওয়া থেকে বিরত থাকছি। আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ), কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) ও লকডাউন (অবরুদ্ধ করা)—এসব ব্যবস্থা কার্যকর করা হচ্ছে। এগুলো আমাদের দেশে হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী হচ্ছে। একটাই উদ্দেশ্য: সংক্রমণ প্রতিরোধ।

আমি টিকাবিজ্ঞানী। টিকা দিয়ে কীভাবে এই ভাইরাস প্রতিরোধ করা যায়, সেই প্রচেষ্টা বা উদ্যোগের কিছু বিষয় মানুষকে অবহিত করা প্রয়োজন। মানুষকে অহেতুক আশা দেওয়া নয়, বিজ্ঞানভিত্তিক একটি আলোর রেখা সবার সামনে তুলে ধরা দরকার। শুরুতেই বলে রাখি, টিকার মাধ্যমে ৫০-৬০ শতাংশ মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ (হার্ড ইমিউনিটি) ক্ষমতা গড়ে তোলা সম্ভব হলে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশ মানুষকে নির্দিষ্ট সংক্রমণ থেকে নিরাপদে রাখা যায়। অন্য সংক্রামক রোগের উদাহরণের ওপর ভিত্তি করে এটা বলছি।

শুরুতে একটি কথা বলে রাখা ভালো, এই ভাইরাস নিয়ে যত ধরনের গবেষণাকাজ হচ্ছে, তা মোটামুটি উন্মুক্ত। গবেষকদের ভেতর একটি প্রবণতা থাকে, গবেষণালব্ধ তথ্য বা আবিষ্কার লুকানোর বা চেপে যাওয়ার। নতুন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। পৃথিবীর বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা একে অন্যের কাজ দেখতে পারছেন।

অন্য ভাইরাস যত ছোট হয়, নতুন ভাইরাসটি ঠিক তেমন নয়। এটি আরএনএ ভাইরাস এবং তুলনামূলক বড়। এই ভাইরাসের জিনের গঠন সম্পর্কে মানুষ জানতে পারে জানুয়ারির মাঝামাঝি। এটির জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। এরপরই বিজ্ঞানীরা এর টিকা আবিষ্কারের জন্য মাঠে নেমে যান। যে তিনটি টিকার কথা বলছি, তা হবে নিউক্লিক অ্যাসিড ভ্যাকসিন। এমন টিকার সুবিধা হচ্ছে এটি দ্রুত ও একই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে তৈরি করা যাবে।

মনে রাখতে হবে, কোনো কোনো টিকা মানুষের ব্যবহার উপযোগী করতে প্রায় ১০০ বছর লেগেছে। ধারণা করা হচ্ছে কোভিড–১৯–এর টিকা ১২-১৮ মাসের মধ্যে মানুষ পেয়ে যাবে। যদি সেটা হয়, তাহলে তা হবে দ্রুততম সময়ে পাওয়া কোনো টিকা।

বেশ কিছু স্তর পার হয়ে একটি টিকা মানুষের জন্য ব্যবহার উপযোগী হয়। প্রথম স্তরে টিকা তৈরি হয় ল্যাবরেটরিতে। এরপর তা ‘অ্যানিমেল মডেলে’ প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ ইঁদুর, গিনিপিগ, বানর, শিম্পাঞ্জি বা অন্য প্রাণীতে ব্যবহার করে দেখা হয় তার বিষক্রিয়া দেখা দেয় কি না। এই স্তরকে বলে প্রিক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এরপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়। এই স্তরে টিকা মানুষের ওপর পরীক্ষা করা হয়। দেখা হয়, এটা কতটা কার্যকর, এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না।

প্রথম ধাপে (ফেজ–১) অল্প সংখ্যক মানুষের ওপর পরীক্ষা করে দেখা হয়। এরপর দ্বিতীয় ধাপে (ফেজ–২) মানুষের সংখ্যা বাড়ানো হয়। তৃতীয় ধাপে (ফেজ–৩) র‌্যান্ডোমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল করা হয়। অর্থাৎ কিছু সংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়া হবে এবং সমান সংখ্যক মানুষকে ‘ছদ্ম টিকা’ দেওয়া হবে। তারপর ফলাফল বিশ্লেষণ করা হবে।
সিয়াটল, অক্সফোর্ড ও উহানের টিকাগুলো প্রথম ধাপে আছে। ইতিমধ্যে ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী ৬৫০ জন সুস্থ মানুষকে এই ট্রায়ালে যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও ১১টি টিকা প্রিক্লিনিক্যাল স্তরে আছে। এর বাইরে আরও ৩৩টির ওপর গবেষণা চলছে।

লেখক: সদস্য, স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভাইজরি গ্রুপ অব এক্সপার্ট, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মিউকোসাল ইমিউনোলজি ইউনিটের প্রধান, আইসিডিডিআরবি