বাউল আসর বন্ধ, সংসার তো চলে না

সিলেটের বাউল বশিরউদ্দিন সরকার। ছবি: প্রথম আলো
সিলেটের বাউল বশিরউদ্দিন সরকার। ছবি: প্রথম আলো

'বিশ্ববাসী রইয়াছে চিন্তায়, করোনাভাইরাসের দায়। হায় রে হায়, শান্তি দিবা একমাত্র মাবুদ আল্লায়'—নিজের লেখা গানে সুর করে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছিলেন বাউল বশিরউদ্দিন সরকার (৫৬)। পাশে তাঁর স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৪৫) ঢপকি বাজাচ্ছিলেন। সিলেট নগরের নোয়াপাড়া এলাকায় ভাড়াবাসায় থাকেন তাঁরা। সে বাসাতেই গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বশিরউদ্দিন একের পর এক গান শুনাচ্ছিলেন।

প্রথম গানটি শেষ করে দ্বিতীয় গানে সুর তোলেন বশিরউদ্দিন—'এই অবস্থা থাকে যদি, দেশ চলবে কী করে?গরিব যারা সর্বহারা, না খেয়ে মরে যাবে। আগুন লেগেছে নিত্যপণ্যের বাজারে, সব নাগালের বাইরে।' এবার থামেন তিনি। বলেন, 'খুব বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। করোনাভাইরাসের কারণে কোথাও গানের আসরে ডাক পড়ছে না, সব বন্ধ হয়ে আছে। অথচ গান গেয়ে যে টাকা পাই, তা দিয়েই সংসার চালাই। হাতে টাকা নেই। কারো কাছে লজ্জায় হাতও পাততে পারি না। এমন অবস্থা আরও কিছুদিন চললে তো না খেয়েই মারা যাব!'

বশিরউদ্দিনের গৃহিণী স্ত্রী রোকেয়া বললেন, তিন সদস্যের পরিবার তাদের। স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও তাদের সঙ্গে স্বামীর ভাইয়ের এক ছেলে থাকে। বাসা ভাড়া ৫ হাজার টাকা। সঙ্গে বিদ্যুৎ বিল। খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে আরও খরচ পড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। অথচ মার্চ মাসে তাঁর স্বামীর কোনো গানের অনুষ্ঠান ছিল না। তাই ধার–দেনা করে গত মাসে সংসার চালিয়েছেন। চলতি মাস কেমন করে চালাবেন, এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।

অনেক দিন পর হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইলেন জানিয়ে বশিরউদ্দিন বলেন, 'গানের আসর বন্ধ। মনটা সারাক্ষণ চিন্তায় অস্থির থাকে। গত জানুয়ারি মাসে রেডিওতে গান গাইতে ডাক পড়েছিল। এরপর আর ডাক পাইনি। সেখানে গান গাওয়ার ডাক পেলে ১ হাজার ৭৮০ টাকার চেক পাইতাম। এই সময়টাতে এই টাকা পাইলেও তো মন্দ ছিল না। কি যে কর!' এই বাউল প্রয়াত বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের শিষ্যত্ব নেন ১৯৮৫ সালে। বলেন, 'এমন দুঃসময় কখনো আসেনি। বাবা (শাহ আবদুল করিম) লিখেছিলেন—দিন হতে দিন আসে যে কঠিন। এই কথার বাস্তবতা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাইতাছি!'

বশিরউদ্দিন সরকার বলেন, বৃহত্তর সিলেটের চার জেলায় শতাধিক বাউলশিল্পী আছেন। দুই-চারজন বাদে সবার অবস্থা তাঁরই মতো। সবাই গরিব ও অসহায়। বিভিন্ন আসরে গান গেয়ে যে টাকা উপার্জন করেন, তা দিয়েই সংসার চলে। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গত মাস থেকে গানের আসর বন্ধ আছে। এতে বাউলদের একতারা-দোতারার সুর থেমে আছে। সবাই এখন সরকারি নির্দেশনা মেনে ঘরেই সময় কাটাচ্ছেন। অনেক বিত্তবান ব্যক্তি অসহায় মানুষদের সহায়তা করলেও বাউলদের কথা কেউ মাথায় রাখেন না।

এই বাউল বলেন, কয়েকজন বাউল তাঁর কাছে তাদের অসহায়ত্বের কথা বলেছেন। কিন্তু নিজেই যেখানে অসহায়, সেখানে তাদের সহযোগিতা করবেন কীভাবে? এই কয় দিনে বেশ কয়েকটি নতুন গান লিখে সুর করার চেষ্টা করেছেন বলে জানালেন। এর মধ্যে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে দুটি গানও আছে। কথা শেষ করেই গানে টান দেন বশিরউদ্দিন—'বাংলাদেশ সরকারের কাছে জানাই আমার মিনতি। জীবন বাঁচানো দায়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। করবেন তাহার সুনীতি, বলে বাউল বশিরে।'