ল্যাব বাড়লেও নমুনা সংগ্রহে ঘাটতি

ছবিটি প্রতীকী। ছবি: রয়টার্স
ছবিটি প্রতীকী। ছবি: রয়টার্স
>ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ১৪টি কেন্দ্রে দিনে চার হাজার নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। হচ্ছে সামান্য।

কোভিড–১৯ রোগের পরীক্ষাকেন্দ্রের (ল্যাবরেটরি) সংখ্যা বেড়েছে। সেই তুলনায় পরীক্ষার সংখ্যা বাড়েনি। কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার ১২ শতাংশ ব্যবহার করতে পারছে সরকার। এ পরিস্থিতিতে নমুনা সংগ্রহ ও সরবরাহ বাড়াতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে প্রথম থেকেই রোগের পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত শুক্রবারও সংস্থাটির প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, রোগী শনাক্ত করা, পরীক্ষা করা এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা জরুরি। এ ছাড়া তিনি তথ্য সংগ্রহ করা এবং যোগাযোগ কার্যক্রম জোরদার করার কথা বলেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও রোগের পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। গতকাল ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, পরিস্থিতি বোঝার জন্য সারা দেশে নমুনা সংগ্রহের বিস্তার ঘটানো হয়েছে। আরও বেশি নমুনা সংগ্রহ করা হবে। রোগীর সংখ্যা বেশি হলে সেটা জেনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

দেশে এখন ১৪টি কেন্দ্রে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তকরণ পরীক্ষা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকায় ৯টি ও ঢাকার বাইরে ৫টি কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে দৈনিক কমপক্ষে চার হাজার নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা আছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৪৩৪টি। দেশে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৫৪৭ জনের কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষা হয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যা খুবই কম।

শুরু থেকে কোভিড–১৯ রোগের পরীক্ষা করে আসছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা গত দুই মাসে একাধিকবার সাংবাদিকদের বলেছেন, দিনে এক হাজার নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা তাঁর প্রতিষ্ঠানের আছে। কিন্তু তিনি দিনে এখনো ২০০টি পরীক্ষা করতে পারেননি।

ল্যাবরেটরিগুলোর সমন্বয়ের দায়িত্বে আছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। তিনি গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, নমুনা সংগ্রহের পরিমাণ বাড়িয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

আরও কিছু কেন্দ্রে পরীক্ষা শুরুর কথা বলেছে সরকার। কিন্তু সেসব কেন্দ্রে ঠিক কবে নাগাদ পরীক্ষা শুরু হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।

৩ এপ্রিল সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছিল, কোভিড–১৯ পরীক্ষার জন্য রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ল্যাবরেটরি প্রস্তুত। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করে জানা গেছে, তারা প্রস্তুত নয়।

নমুনা সংগ্রহের নানা ধরন

অপরিকল্পিত নমুনা সংগ্রহের কারণে কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। একেক প্রতিষ্ঠানের জন্য নমুনা সংগ্রহের রীতি একেক রকম।

ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন ৩১ মার্চ কোভিড-১৯ রোগের পরীক্ষার অনুমতি পেয়েছে। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত মাত্র তিনজনের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করেছে। তাদের দিনে ৫০০ নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা আছে।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউট, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল—এই আটটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সন্দেহভাজন রোগীদের নমুনা পরীক্ষার দায়িত্ব পেয়েছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন।

আবার ওই আটটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের কোভিড–১৯ পরীক্ষার দায়িত্ব পেয়েছে বেসরকারি চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন। তাদের সঙ্গে আছে ঢাকা শিশু হাসপাতাল। তারা এ পর্যন্ত ৩৯টি নমুনা পরীক্ষা করেছে। দিনে তাদের দুই শতাধিক নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা আছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে সন্দেহভাজন রোগীদের মধ্য থেকে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করছে ঢাকা মেডিকেল। একইভাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার কাজ করছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)। এই দুটি প্রতিষ্ঠান কিছুটা স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। বিএসএমএমইউ এ পর্যন্ত ৩৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করেছে। দৈনিক প্রতিষ্ঠানটি ৮০ জনের পরীক্ষা করতে পারে।

নমুনা সংগ্রহ, বিতরণ ও ফলাফল ঘোষণার একক কর্তৃত্ব অন্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় আইইডিসিআরের বেশি। এ প্রতিষ্ঠানটি সংগৃহীত নমুনা অন্য প্রতিষ্ঠানকেও সরবরাহ করে। আইইডিসিআরের কাছ থেকে দৈনিক ১৫ থেকে ২০টি নমুনা পাচ্ছে ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভস (আইদেশি)। আইদেশির দৈনিক ৪৫০টি নমুনা পরীক্ষার ক্ষমতা আছে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) দৈনিক ৭০০ নমুনা পরীক্ষা করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি এখন শুধু নিজেদের সন্দেহভাজন কর্মীদের নমুনা পরীক্ষা করছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তাদের গতকাল পর্যন্ত কোনো নমুনা দেওয়া হয়নি।

উপজেলার নমুনা

গত সপ্তাহে জেলা ও উপজেলা থেকে আসা নমুনা পরীক্ষার অনুমতি পায় সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আব্দুর রহিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত ২১৮টি নমুনা আমরা জেলা ও উপজেলা থেকে পেয়েছি। ইতিমধ্যে ১০৮টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি।’ প্রতিষ্ঠানটির দিনে নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা ২০০টি।

গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় প্রতিটি উপজেলা থেকে দুটি করে নমুনা পাঠানোর। ওই দিন এক হাজার নমুনা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।

ওই দিন প্রথম আলো দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। শুধু কয়রা উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণকরে নমুনা পাঠানোর কথা বলেছিলেন। অন্য দুই উপজেলা লোকবল ও সরঞ্জামের অভাবের কারণে নমুনা সংগ্রহ করেনি ও জেলায় পাঠায়নি।

ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি

প্রায় এক মাস আগে থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর বলে আসছে, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করা হবে। চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসকে (বিআইটিআইডি) চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং পরীক্ষা শুরু হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআর একটি ল্যাবরেটরি করেছিল কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেই ল্যাবকেও এখন কোভিড–১৯ শনাক্তের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এ ছাড়া ময়মনসিংহ, রংপুর ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ল্যাব কাজ শুরু করেছে তিন দিন আগে থেকে। কাজ শুরু হয়নি খুলনা, সিলেট ও বরিশাল বিভাগে।

খুলনা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস এম তুষার আলম বলেন, আগামী বৃহস্পতিবার পরীক্ষা শুরু হবে। সিলেট এমএ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ বলেছে, আগামী মঙ্গলবার পরীক্ষা শুরু করা যেতে পারে।

বরিশালে কবে ল্যাব চালু হবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। ল্যাবটির অবকাঠামো নির্মাণের কাজ গতকালপর্যন্ত শেষ হয়নি। সে কাজ শেষ হলে যন্ত্র স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া ভাইরোলোজিস্ট ও টেকনিশিয়ানের পদও খালি আছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক মহামারি শুরুর ঘোষণার আগে থেকে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বলে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশে পরীক্ষা কম হচ্ছে। পর্যাপ্ত কিটও সরকারের কাছে আছে। কিন্তু কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে ব্যবহার করতে পারছে না।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, দ্রুততার সঙ্গে পরীক্ষা বাড়ানোর সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। সঠিকভাবে নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রশিক্ষিত মাঠকর্মীর সংকট থাকলে অণুজীববিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। ঢাকার বাইরে পরীক্ষার সমান সুযোগ রাখতে হবে।