করোনা চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালটিতে 'শুধু নেই আর নেই'

১০ দিন আগে চিকিৎসক শামীম আরা কেয়াকে কমলাপুরের রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালে পদায়ন করা হয়। প্যাথলজিস্ট বিভাগের একজন পরামর্শক তিনি। চিকিৎসক শামীম আরা কেয়া রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালে যোগদান করে জানতে পারেন, হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে একটি মাইক্রোস্কোপও নেই। 

শামীম আরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য কমলাপুর রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল নির্ধারিত হওয়ায় আমাকে এই হাসপাতালে পদায়ন করা হয়। আমি দেখছি, এই হাসপাতালে প্যাথলজি কোনো সেটআপ নেই। নেই রিএজেন্টও। মাইক্রোস্কোপ নেই। বলতে গেলে, কাজ করার মতো কিছুই নেই।’

শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চিকিৎসক শামীম আরার মতো আরও ছয় চিকিৎসককে রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালে পদায়ন করা হয়েছে। ছয়জন চিকিৎসকের একজন রবিউল ইসলাম। তিনি অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের পরামর্শক। রবিউল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু করোনা সেন্টার হিসেবে আমাকে পদায়ন করা হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম, নিশ্চয় সবকিছুই এই হাসপাতালে আছে। এই হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) নেই। প্রস্তুত নেই কোনো শয্যাও (বেড)।’

করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালকে নির্ধারণ করলেও বাস্তবে এই হাসপাতালে অনেক কিছুই নেই।

হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ছবি: আসাদুজ্জামান
হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। ছবি: আসাদুজ্জামান

হাসপাতালটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা দুজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেছেন, করোনায় আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যে অবকাঠামো থাকা দরকার, তার কিছুই নেই এই হাসপাতালে। এই মুহূর্তে অন্তঃবিভাগ চালু করা অসম্ভব। তবে বহির্বিভাগে করোনার লক্ষণ নিয়ে আসা ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। আরও সম্ভব রোগীদের কোয়ারেন্টিনে রাখার।

শুধু নেই আর নেই
কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশে অবস্থিত পাঁচ একর জায়গায় বাংলাদেশ রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল। ৩৪ বছর আগে (১৯৮৬) হাসপাতালটির জন্ম। শুরুতে হাসপাতালটির নাম ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল। হাসপাতালটিতে তখন শুধু রেলওয়ে কর্মীরা চিকিৎসা সেবা পেতেন।

পাঁচ বছর আগে (২০১৫) অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের মতো চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য রেলওয়ে হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল।
হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালে যেসব চিকিৎসা সরঞ্জাম রয়েছে তা অনেক পুরোনো। যেসব যন্ত্রপাতি আছে, তার সবই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। হাসপাতালের শয্যাগুলোও নষ্ট।

হাসপাতালের শয্যাগুলো প্রস্তুত নয়। ছবি: আসাদুজ্জামান
হাসপাতালের শয্যাগুলো প্রস্তুত নয়। ছবি: আসাদুজ্জামান

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ ফিরোজ আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের আছে। কিন্তু অন্তঃবিভাগে পুরোপুরি চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়। অন্তঃবিভাগে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য ব্যাপক পরিবর্তন দরকার। হাসপাতালে অক্সিজেন সাপ্লাই (সরবরাহ) থাকা দরকার, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকা দরকার। এসব ঠিক না করে অন্তঃবিভাগ (ইনডোর) সেবা চালু করা যাবে না।

রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল কখনো অন্তঃবিভাগ তেমনভাবে চালু ছিল না বলে জানান চিকিৎসক সৈয়দ ফিরোজ আলমগীর। তিনি বলেন, ‘রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল কখনো ইনডোর (অন্তঃবিভাগ) ওরিয়েন্টেড হাসপাতাল ছিল না। এই হাসপাতালটি ছিল শুধু রেলওয়ে কর্মীদের জন্য। কেউ আহত হলেই কেবল তাদের অন্তঃবিভাগে ভর্তি করা হতো। যে হাসপাতালে আগে ইনডোর ছিল না, সেই হাসপাতালে ইনডোর বিভাগ চালু করতে হলে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।’

জটিল রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া জেনারেল হাসপাতালে সম্ভব নয়, মন্তব্য করে তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ ফিরোজ আলমগীর বলেন, ‘ক্রিটিক্যাল রোগীদের চিকিৎসা এই হাসপাতালে সম্ভব না। তবে রোগী ট্রিটমেন্ট দিতে পারব না, তা বলব না। মানুষ অভ্যস্ত, রেলের হাসপাতাল মানেই উইক হাসপাতাল। এই ধারণা বছরের পর বছর রয়ে গেছে। আমাদের এখানে প্যাথলজির টেস্টের কোনো ব্যবস্থা নেই।’

করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নির্ধারিত রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল। ছবি: আসাদুজ্জামান
করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নির্ধারিত রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল। ছবি: আসাদুজ্জামান

রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রেলওয়ে ঢাকা বিভাগীয় চিকিৎসা কর্মকর্তা আই এস আবদুল আহাদ বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালটি রেলের মালিকানাধীন। করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত করার পর হাসপাতালের সংস্কারকাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের অন্তঃবিভাগে (ইনডোর) সেবায় অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। রোগী ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়ার মতো অবস্থা এখন হয়নি। রোগী ভর্তির জন্য যে বেড থাকা দরকার, সেটিও নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, এখন রাতারাতি এই হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যার হাসপাতালে রূপান্তর করা অসম্ভব। যে বেড আমাদের এখানে ছিল, সেগুলো নষ্ট, যে কারণে বেডের চাহিদাপত্র দিয়েছি।’

চিকিৎসক আবদুল আহাদ বলেন, ‘রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যার হাসপাতালে রূপান্তরিত করতে হলে কমপক্ষে ৪০ জন নার্স দরকার। আমাদের এখানে আছে মাত্র আট থেকে দশজন। আমাদের মেডিকেল অফিসার দরকার ২৫ থেকে ৩০ জন। সব মিলিয়ে চিকিৎসক এখন আছে ১৭ থেকে ১৮ জন।

রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, এই হাসপাতালে এখন একটি মাত্র অ্যাম্বুলেন্স চালু রয়েছে।

হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ ফিরোজ আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালকে ১০০ বেডের হাসপাতাল করার জন্য যা যা দরকার, তার সবই আমরা চেয়েছি। গত সপ্তাহে আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছি। আমাদের দরকার মেডিকেল অফিসার, দরকার যানবাহন, জেনারেটর। অর্থাৎ রোগী দেখতে যা যা লাগে, সবই আমরা চেয়েছি।’