মাথায় দুশ্চিন্তা, মনে অশান্তি

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে চলছে সাধারণ ছুটি। কাজ বন্ধ। রাজধানীর বস্তিবাসীদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। গতকাল দুপুরে মহাখালীর বাউন্ডারি বস্তিতে।  ছবি: প্রথম আলো
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে চলছে সাধারণ ছুটি। কাজ বন্ধ। রাজধানীর বস্তিবাসীদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। ত্রাণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ। গতকাল দুপুরে মহাখালীর বাউন্ডারি বস্তিতে। ছবি: প্রথম আলো

রোদে ঝাঁজালো দুপুর। মহাখালীর পোড়া বস্তির সামনে পাশের ভবনের ছায়ায় রাখা রিকশাভ্যানের ওপর শুকনা মুখে বসে ছিলেন ওলিউল্লাহ (৫২)। স্ত্রী নূরুন্নাহারও পাশেই ভ্যানে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো। এই বস্তিতেই তাঁরা থাকেন তিন হাজার টাকা ভাড়ার এক ঘরে। ওলি এই রিকশাভ্যান চালান। প্রতিদিন পাঁচ-ছয় শ টাকা তাঁর আয়। নূরুন্নাহার নিকেতনে এক বাড়িতে গৃহকর্মীর বাঁধা কাজ করেন, বেতন মাসে ছয় হাজার টাকা। দুজনের মিলে ২০-২২ হাজার টাকা মাসে আয় হয়। তাই দিয়ে চলে সাতজনের সংসার।

কিন্তু করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে ঘরে বসে থাকায় গত ১০ দিন এই দম্পতির রোজগার বন্ধ। সামান্য কিছু সঞ্চয় ছিল, সেখানেই হাত পড়েছে। ঘরে থাকার মেয়াদ বাড়তে থাকায় তাঁরা খুবই শঙ্কিত। তাঁদের মতোই অন্য বস্তিবাসীরাও খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

ঢাকার পুরোনো এবং বড় বস্তিগুলোর মধ্যে মহাখালীর সাততলা বস্তি অন্যতম। এখানেই একসঙ্গে আছে চৌধুরীপাড়া বস্তি, বাউন্ডারি বস্তি, স্টাফ কোয়ার্টার বস্তি, পোড়া বস্তি, লালমাটির বস্তি ও সাততলা বস্তি। সব কটি মিলিয়েই সাততলা বস্তি। এটি পড়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডে। পুরো সাততলা বস্তিতে প্রায় ১৭ হাজার পরিবারের ৬০ হাজার নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস। গতকাল রোববার দুপুরে সাততলা বস্তিতে গিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল গত মাসের ২৬ তারিখ থেকেই তাঁরা প্রায় কর্মহীন দিন কাটাচ্ছেন। এই বস্তির নারীদের মধ্যে অনেকে আশপাশের পোশাক কারখানার কর্মী। আরেকটি বড় অংশ বনানী, গুলশান, নিকেতন, বাড্ডা, মহাখালী থেকে রামপুরা, খিলগাঁও ইস্কাটন, সিদ্ধেশ্বরী, মালিবাগ—এসব এলাকায় ঠিকা বা স্থায়ী হিসেবে গৃহকর্মীর কাজ করেন। তাঁরা সবাই এখন বেকার। পোশাক কারখানা বন্ধ আর বাসাবাড়ির কর্তারা গৃহকর্মীদের কাজে যেতে বারণ করে দিয়েছেন।

পুরুষদের বিভিন্ন রকম পেশা। অধিকাংশই রিকশা বা ভ্যানচালক। এ ছাড়া আছেন দিনমজুর, ফেরিওয়ালা, হোটেল ও দোকান কর্মচারী। হাত গুটিয়ে ঘরে বসে থাকায় সবারই মাথায় দুশ্চিন্তা, মনে অশান্তি।

পোড়া বস্তির রিকশাচালক সুজন মিয়া বললেন, রিকশা নিয়ে বের হলেই পুলিশ এসে ধরে। বস্তির গলি থেকে বেরই হতে দেয় না।

রসুলবাগের একটি পোশাকের শোরুমের কর্মচারী সাদ্দাম হোসেন থাকেন লালমাটির বস্তিতে, বেতন পান ১০ হাজার টাকা। তাঁর স্ত্রী বিলকিস পোশাক কারখানার সেলাই সহকারীর কাজ করেন আট হাজার টাকা বেতনে। দুই সন্তান নিয়ে চারজনের সংসার। ঘরভাড়া সাড়ে তিন হাজার টাকা। দুজনের আয়ে কোনোমতে সংসার চলে। এখন দুজনেরই আয় বন্ধ। কোনো সাহায্য পাননি। তিনি বলছিলেন, এই পরিস্থিতিতে যদি অন্তত তাঁদের ঘরভাড়া মওকুফ করার ব্যবস্থা করা হতো, তাহলেও অনেক বড় উপকার হয়।

বস্তিগুলোতে ১০ ফুট বাই ৮ ফুট এবং ৮ বাই ৮ ফুট—দুই রকমের ঘর আছে। বড়গুলোর ভাড়া মাসে সাড়ে তিন হাজার এবং ছোটগুলোর ভাড়া তিন হাজার টাকা।

গতকাল দুপুরে বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলার সময় অনেকে ভেবেছিলেন ত্রাণ দেওয়া হবে। এ জন্য নারী-পুরুষ, ছোট-বড় অনেকেই এগিয়ে এসে বলছিলেন তাঁদের নাম লিখে নিতে। তাঁদের মধ্যে সাততলা বস্তির দিনমজুর রুহুল আমিন, চৌধুরীপাড়া বস্তির রিকশাচালক হানিফ, পোড়া বস্তির পোশাককর্মী আকলিমা, গৃহকর্মী বিউটিসহ অনেকে বললেন, তাঁরা ত্রাণসহায়তা এখনো পাননি। কেউ কেউ ক্ষোভের সঙ্গে অভিযোগ করলেন, মাঝেমধ্যে মুখ চিনে সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। সবাই পাচ্ছেন না।

ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নাসির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদের মাধ্যমে তিনি মোট ৯০০ বস্তা ত্রাণসামগ্রী পেয়েছিলেন। গত শুক্রবার তা বিতরণ করা হয়। প্রতি বস্তায় ছিল ১০ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, ১ কেজি করে ডাল ও পেঁয়াজ। তিনি বললেন, ১৭ হাজার পরিবারের মধ্যে ৯০০ বস্তা ত্রাণ দিলে কারা পেল, তা খুঁজে পাওয়া কঠিন। কাউন্সিলর জানান, ওয়াসাসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা বা ব্যক্তি নিজেদের উদ্যোগে ত্রাণ দিলেও বিষয়টি তাঁর জানা নেই।