ইতালিতে অবরুদ্ধ স্বজনেরা টাকা পাঠাতে পারছেন না, বিপদে পরিবার

শরীয়তপুর
শরীয়তপুর

ইতালির শহর মিলান। সেখানে কাজ করেন শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার খরকরা গ্রামের পাভেল মাঝি। ইতালিতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর কর্মস্থল বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুই মাস ধরে লকডাউনে আছেন তিনি। অবরুদ্ধ পাভেলের কাজ বন্ধ, আয়ও বন্ধ। ফলে বাংলাদেশে পরিবারের জন্য টাকা পাঠাতে পারছেন না। মাস চলার টাকা না পেয়ে বিপদে আছে তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

পাভেল মাঝি মেসেঞ্জারে প্রথম আলোকে বলেন, 'বাবা মারা যাওয়ার পর ২০১০ সালে কাজের সন্ধানে ইতালিতে আসি। এখানে যা আয় হতে, দেশে স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে দিতাম। দেশে মা, ছোট ভাই, স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তান আছে। আমার পাঠানো টাকায় তাদের সংসার চলে। দুই মাসের বন্দী জীবনে হাঁপিয়ে গেছি। বিপদের সময় হাতে টাকা নেই। বাংলাদেশেও পরিবার ভালো নেই।'

নড়িয়ার খরকরা গ্রামে থাকা পাভেলের ছোট ভাই রাজিব মাঝি বলেন, 'বিদেশে ভাই অবরুদ্ধ অবস্থায় আতঙ্ক নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। এ দিকে দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় আমরাও ঘরবন্দী। জানুয়ারি মাসের পর ভাই আর টাকা পাঠাতে পারেননি। ওই দিকে ভাই টাকার সংকটে, এদিকে আমরা। কেউ কাউকে সহায়তা করতে পারছি না।'

ইতালিতে বসবাসকারী বাংলাদেশি প্রবাসীদের সংগঠন ইতালির বাংলাদেশ সমিতির সাবেক একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, 'এই মুহুর্তে ইতালিতে মহামারি চলছে। বাংলাদেশি প্রবাসীরা নানা ধরনের সংকটের মধ্যে পড়েছেন। বাংলাদেশি এখানে যারা আছেন, তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন হোটেল, বার ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক মালিক ইতিমধ্যে মারা গেছেন। করোনার প্রাদুর্ভাব কেটে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলোর কী হবে, কর্মীরা কাজ পাবেন কিনা; তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া মানুষ কবে নাগাদ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

এই ব্যক্তি আরও বলেন, দুর্যোগপূর্ণ এ পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতালির সরকার ইতিমধ্যে তার দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি প্রবাসীদের সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কমিউনিটি বেইজ প্রবাসীদের ৩০০ থেকে ৭০০ ইউরো পর্যন্ত দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে অনলাইনে আবেদন সংগ্রহ শুরু করেছে। আর যাদের ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে, তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়ন করা হবে।

নড়িয়ার সোনার বাজার এলাকার বাসিন্দা স্বপন হোসেন ইতালির নাপলিতে একটি শিল্প কারখানায় কাজ করেন। গত ফেব্রুয়ারিতে কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারখানাটির পরিচালনা পর্যায়ের কয়েকজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। বন্ধ হওয়ার সময় বেতনও তুলতে পারেননি তিনি। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে তিনি ঘরে আটকা আছেন। দুই মাসের খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস ঘরে মজুদ করেছিলেন। এখন তাও শেষ পর্যায়ে। সর্বশেষ জানুয়ারিতে দেশে স্ত্রীর কাছে টাকা পাঠিয়েছিলেন।

স্বপন হোসেন বলেন, 'দেশ থেকে ফোন করে টাকা পাঠানোর কথা বলে। এখানকার অবস্থা খুবই খারাপ।এখন টাকা পাব কোথায়? স্ত্রীকে বলেছি, আপাতত ধার নিয়ে চলার জন্য। করোনার প্রভাব কেটে গেলে প্রতিষ্ঠানটি চালু হবে কিনা, তাও বুঝতে পারছি না। কাজ ফিরে পাব না হারাব, সেই দুশ্চিন্তা তো আছেই।'

স্বপনের স্ত্রী রাশেদা আক্তার বলেন, 'স্বামী ইতালি থাকেন বলে আত্মীয়-স্বজনেরা মনে করেন আমরা অনেক টাকার মালিক। আমরা যে কী কষ্টে আছি, তা কাউকে বোঝাতে পারছি না। স্বামী দুই মাস টাকা পাঠাননি। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। স্বামীও ইতালিতে খারাপ অবস্থায় আছেন।'

নড়িয়ার ভোজেশ্বর এলাকার এক যুবক ২০০৫ সাল থেকে ইতালির রোমে থাকেন। তিনি সেখানে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কাজ হারিয়ে এখন ঘরবন্দী ওই যুবক। মেসেঞ্জারে তিনি বলেন, 'আমি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ঋণ করে ইতালিতে এসেছি। সংসার চালানোর পাশাপাশি ঋণ পরিশোধ করেছি। কোনো সঞ্চয় করতে পারিনি। ইতালিতে আমি আর দেশে আমার পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। কাজ হারানোর শঙ্কায় আছি। খালি হাতেই ইতালি থেকে ফিরতে হয় কিনা, সারাক্ষণ সেটাই ভাবছি।'