এত খেটে খাওয়া মানুষ কোথায় গেলেন?

রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকার ফার্মগেট এখন এমন। ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকার ফার্মগেট এখন এমন। ছবি: প্রথম আলো

একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। চাকরিটা হুট করে চলে গেছে। সন্তান ও মা-বাবা নিয়ে ঢাকায় থাকেন। সঞ্চয় বলতে কিছুই নেই। শ্বশুরবাড়ির পরিবারও স্বামীর আয়ের ওপর নির্ভরশীল। ফেসবুকে পেজ খুলে একটা ব্যবসা শুরু করেছিলেন। স্বামীর আয় ও নিজের সামান্য কিছু রোজগার দিয়ে টেনেটুনে চলছিল নিম্নমধ্যবিত্তের টানাটানির সংসার। করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই পরিবার অথই পানিতে পড়েছে। অনেক দিনের পরিচয়, মুঠোফোনে বলতে লজ্জা করায় দীর্ঘ একটা মেইল করেছেন নিজের দুরবস্থার কথা জানিয়ে। ছাত্রজীবনে ত্রাণ বিতরণের কাজে যুক্ত থাকার কারণে অনুরোধ করেছেন, এ রকম কোনো সংস্থা-ব্যক্তি ছবি না তুলে ত্রাণ বিতরণ করলে তিনি যোগাযোগ করতে চান।

ঢাকায় অথবা মফস্বলে থাকা এ রকম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষজনের সংখ্যা কত, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। প্রতিদিন এ রকম অনেক মানুষ সহায়তার অনুরোধ জানাচ্ছেন। এসব নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের মহামারির সময় এক মাস টিকে থাকার মতো সঞ্চয় নেই।

যে গলিতে থাকি, সেখান থেকে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত ফল বিক্রেতা, টংঘরের চায়ের দোকানদার, ভ্যানগাড়ির সবজি বিক্রেতা, বাদাম-বুট-ছোলা বিক্রেতা, জুতা সেলাইয়ের কারিগর, সেলুনের কর্মী থেকে অসংখ্য পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে রোজ দেখা হয়। তাঁদের অনেকের সঙ্গেই আমার চোখাচোখি হয়, কারও সঙ্গে কথা হয়, অনেকের ভালো–মন্দের খবরও শুনি।

জীবন তাঁদের একটু আয়েশ করে পা ছড়িয়ে গল্প করার ফুসরত দেয়নি। উদয় অস্ত খেটে তিন বেলা ভাত, মোটা কাপড়, থাকার জন্য সামান্য একটু জায়গা জোগাড় করতে গিয়ে তাঁদের চুল পাকে, ডায়বেটিস হয়—তারপর অলক্ষ্যে যেমন ঝরে যায় বুনো ফুল, তাঁরাও একদিন টুপ করে মরে যান। তাঁদের মরে যাওয়ার পর ঘটা করে শেষকৃত্য হয় না, তাঁদের অধিকাংশের ফেসবুক নেই; তাই ফেসবুক রিমেম্বারিংও হয় না। তাঁরা বাংলাদেশের আম আদমি। তাঁরা ১৬ কোটি মানুষের বিপুল অংশ হলেও তাঁরা সমাজের মধ্যে বেঁচে থাকা কিংবা মরে যাওয়ার কোনোটিই মালুম হয় না। তাঁরা হলেন ‘অপার’ মানুষ। সমাজের আউটসাইডার। এই অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অবরুদ্ধ রাজধানীতে এই অপার, আউটসাইডার গরিব মানুষগুলো গেলেন কোথায়?

করোনাভাইরাস সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য সরকার গত ২৭ মার্চ থেকে সারা দেশ বন্ধ করে দিয়েছে। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের প্রথম দিনে রাস্তায় নেমে তাঁদের কারও সঙ্গে আমার দেখা হয় না আর। অথচ জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডের মোড়ে যে পিঠা বিক্রেতা একদিন ফুটপাতে না বসলে যাঁর ঘরের চুলায় হাঁড়ি ওঠে না, তিনি গেলেন কোথায়? জানতে ইচ্ছে করে, এই যে সবজি বিক্রেতা, বাদাম বিক্রেতা, পাড়ার মোড়ের সেলুনের কর্মী, ৮ নম্বর ৯ নম্বর বাসের কন্ডাক্টর—তাঁরা গেলেন কোথায়? যে বাসায় থাকি, সেখানে একজন দুধ বিক্রেতা প্রতিদিন একটি রিকশা করে দুধ দিতে আসতেন। তিনি কোথায় গেলেন?

২৬ মার্চ থেকে কার্যত থেমে আছে দেশ। যাদের কাছে পর্যাপ্ত জমানো অর্থ নেই তাদের পরিস্থিতি কতটা ভয়ানক তা অনেকে আঁচ করতে পারছেন না। সরকার কত মানুষকে সহায়তা দিচ্ছে, কোন জেলায়, কোন উপজেলায় কত, তার হিসাব আমরা জানি না। অথচ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কেরানিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভয়াবহ সংকটের এই সময় সমাজের সব থেকে বড় এই অংশের জন্য রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট কোনো প্যাকেজের কথা এখন পর্যস্ত শোনা যায়নি।

অথচ সংকট শুরুর প্রথম দিকেই রাষ্ট্রের ধনিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা এসেছে। তারপরও তারা কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয়নি। চাকরি বাঁচাতে হাজার হাজার শ্রমিকের অনেকে হেঁটে ঢাকা এসেছেন। কী ভয়াবহ ধনিক শ্রেণি। অন্যদিকে কৃষি ও কৃষক দুটোই বেসরকারি খাত বা প্রাইভেট সেক্টর। কিন্তু সেখানকার কোনো প্যাকেজ নেই কেন?

ইউরোপে একটি গরুর পেছনে বছরে ভর্তুকি ৭০ হাজার টাকা। ভারতীয় সাংবাদিক পি সাইনাথ একবার এক ভারতীয় কৃষক সংগঠককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ভারতীয় কৃষকের স্বপ্ন কী?’ উত্তর এসেছিল, ‘পরের জন্মে ইংল্যান্ডের গরু হয়ে জন্ম নেওয়া।’

এ দেশে অদ্ভুত একটা প্রাইভেট সেক্টর হলো কৃষি। ধরুন, আপনি যদি একটা বদনাও তৈরি করেন, তাহলে বদনার দাম উৎপাদন ঠিক করতে পারবেন। সেই দামের মধ্যে মূলধন, শ্রমিকের শ্রম, কাঁচামালসহ নানা কিছুর পর লাভ ধরে দাম ঠিক করা হবে। কিন্তু একমাত্র কৃষকই ধান, লাউ, বেগুন, আলু যা-ই উৎপাদন করুন, তার দাম তিনি নির্ধারণ করতে পারেন না, সেটা করবে ফড়িয়ারা। তাহলে কৃষক উৎপাদক নন? প্রতিবছর লোকসান করে আবার তিনি ফসল ফলান। এক বছর এই ফসল ফলানো বন্ধ থাকলে গোটা জাতির খাদ্য কি বিদেশ থেকে আমদানি করা সম্ভব? তখন কি খাদ্যের বদলে মানুষ টাকা খাবে?

এই করোনা মহামারির সময় সেসব অগণিত কৃষকের কথা মনে পড়ছে। তাঁরা কোথায়? কী করছেন তাঁরা?

দেশের ৮০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা আসে পোশাক খাত থেকে। অথচ এশিয়ার মধ্যে এ খাতের শ্রমিকেরা সব থেকে কম বেতন পান। ইউনাইটেড স্টেটস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে (ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেঞ্চমার্ক স্টাডি-২০১৭), সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে কাজ করেন গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকেরা। শুধু যেসব কারখানা নিজেরা সরাসরি রপ্তানি করে, তাদের শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু যেসব গার্মেন্টস অন্যের কাজ করে দেয়, তারা কী করবে? কিংবা যেসব প্রতিষ্ঠান বিদেশে পণ্য পাঠায় না, সেসব কারখানার শ্রমিকেরা কী করবেন?

যে কারণে কিউবার কথা প্রাসঙ্গিক

কিউবায় বিপ্লবের আগে ১৯৫৮ সালে চিকিৎসকের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার। জনপ্রতি তখন ১ হাজার ৫১ জনের জন্য একজন চিকিৎসক ছিলেন। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় বিপ্লবের পরে। ষাটের দশকে মাত্র চিকিৎসকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজারে। বাকিরা দেশ ছেড়ে চলে যান। ইউনিভার্সিটি হাভানা মেডিকেল স্কুল যখন পুনরায় চালু করা হলো, তখন মাত্র ২৩ জন অধ্যাপক পাওয়া গেল শিক্ষাদানের জন্য। আর ২০০৮ সালে এসে কিউবার মেডিকেল কলেজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫। চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ লাখ ২ হাজার।

কিউবায় ঘরে ঘরে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ‘কম্প্রিহেনসিভ জেনারেল মেডিসিন’ নামের একটি কর্মসূচি কিউবা হাতে নেয়। এতে একজন মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ, একজন চিকিৎসক ও একজন করে নার্স দিয়ে এই ব্রিগেড গড়ে তোলা হয়। একেকটি স্বাস্থ্য ব্রিগেডের আওতায় ১২০ থেকে ১৫০ পরিবারের ৭০০ থেকে ৮০০ জন মানুষের চিকিৎসাসেবা দেওয়া। এই ব্রিগেডের মূল কাজ প্রতিরোধমূলক চিকিৎসাব্যবস্থা। এই ব্রিগেড তাদের আওতায় থাকা প্রত্যেকের বাড়িতে বছরে অন্তত একবার যাবেই। আরও জটিল কোনো রোগের চিকিৎসায় এর পরের ধাপ বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে আগের চিকিৎসক রোগীর সব রেকর্ড নিয়ে হাজির হন। এভাবে গোটা কিউবায় স্বাস্থ্যসেবার এক অনন্য মডেল তৈরি হয়, যার পুরোটাই বিনা মূল্যে।

অথচ এই দেশকে দশকের পর দশক যুক্তরাষ্ট্র কোয়ারেন্টিন বা একঘরে করে রেখেছে অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে। নব্বইয়ের দশকের দিকে দেশটির এতই করুণ পরিস্থিতি তৈরি হয় যে জরুরি ওষুধ কেনার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলে, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা ওষুধও আমদানি করতে পারেনি। কিন্তু কিউবা হাল ছাড়েনি। সে কারণে আজ যখন ব্রিটিশ মালিকানা জাহাজকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ক্যারিবীয় অঞ্চলে কেউ নোঙর করতে দিতে রাজি হয়নি করোনা আক্রান্ত নাবিক থাকার কারণে, তখন কিউবা তাদের উদ্ধার করে চিকিৎসা দিয়েছে।

দুনিয়ায় মানুষের চেয়ে দামি আর কিছু নেই। যদি অসুস্থ হলে বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, তাহলে ওই সম্পদের সঙ্গে সাধারণ মাটির কী ফারাক আছে?

কোনটা বেশি দরকার—স্বাস্থ্যসেবা না উন্নয়ন? উন্নয়ন অবশ্যই দরকার, তবে আগে স্বাস্থ্যসেবা দরকার।