নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙনে নিঃস্ব পরিবারগুলোর পাশে কেউ নেই

শরীয়তপুর
শরীয়তপুর

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর, মোক্তারের চর ইউনিয়ন ও নড়িয়া পৌরসভায় নদী ভাঙনের শিকার ৫ হাজার ৮১ পরিবারের বসবাস। পদ্মা নদীর ভাঙনে নিঃস্ব পরিবারগুলোর অনেক সদস্য পেশা পরিবর্তন করে দিনমজুরের কাজ, হকারি, মাটিকাটা শ্রমিক হিসেবে কিংবা ভ্যান-রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে মানুষের এখন ঘর থেকে বের হওয়া বারণ। চলছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান। এমন পরিস্থিতিতে গত ১২ দিন ধরে তাদের আয় বন্ধ। জেলা প্রশাসন থেকে ওই দুটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ২৬৯ পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে নদী ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোর সেটা জুটেনি।

স্বামী আর তিন সন্তান নিয়ে মাফিয়া বেগমের পরিবার। কেদারপুর ইউনিয়নের চরজুজিরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন তাঁরা। ২০১৭ ও ২০১৮ সালের ভয়াবহ নদী ভাঙনে ফসলি জমি ও বসত বাড়ি বিলীন হয়ে নিঃস্ব হয় মাফিয়ার পরিবার। আশ্রয় নেন উত্তর কেদারপুর গ্রামের লস্কর বাড়ির জমিতে। স্বামী দিলু খান লঞ্চের কর্মচারী। যা বেতন পান তা দিয়েই সংসার চলে। গত ২৬ মার্চ থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ। ঘরবন্দী দিলু খানের হাতে যা টাকা ছিল, তা দিয়ে কিছু চাল, ডাল ও আলু কিনতে পেরেছিলেন। সেগুলোও শেষের পথে।

মাফিয়া বলেন, 'ঘরে যা চাল–ডাল আছে, তা দিয়ে আর তিন-চার দিন চলবে। বাচ্চারা আলু ভর্তা, ভাত খেতে চায় না, কান্নাকাটি করে। গৃহস্থ পরিবার ছিল আমাদের। কোনো অভাব ছিল না। সুখেই দিন কাটত। আর এখন ত্রাণের লাইন দেখলেই ছুটে যাই।'

উত্তর কেদারপুর গ্রামের বাসিন্দা সখিনা বেগম। ২০১৮ ও ২০১৯ সালের ভাঙনে বসত বাড়ি ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে। অন্যের জমিতে আশ্রয় হয়েছে পরিবারের। স্বামী মতিউর রহমান অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। তিন মেয়ে আছে সংসারে। কলেজছাত্রী এক মেয়ের টিউশনিতে চলত সংসার। এখন টিউশনিও বন্ধ। কীভাবে কী করবেন, স্বামীর ওষুধের টাকা, সংসারের খরচ কোথায় পাবেন, সেই দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তাঁর। জানালেন, এখনো কোনো সহায়তা পাননি তিনি।

সখিনা বেগম বলেন, 'পদ্মা আমাদের সর্বশান্ত করে দিয়েছে। মেয়ের টিউশনির আয়ের উপর সংসার চলে। এখন সব বন্ধ। ঘরে খাবার নেই, কোনো সহায়তাও পাইনি। শেষ জীবনে এসে এমন অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে যাব, ভাবতেও পারিনি।'

কেদারপুর গ্রামের বাসিন্দা জানু বেগম। ২০১৮ সালে পদ্মা তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। আশ্রয় হয়েছে লস্করদের বাগানে। স্বামী জুলহাস মিয়া কাঠমিস্ত্রি। ১২ দিন ধরে কাজে যেতে পারেন না। ঘরের খাবারও শেষ হয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন জানু বেগম-জুলহাস দম্পতি। জানু বেগম প্রথম আলোকে বলেন, 'ঘরে দুই বাচ্চা। এখনো কোনো সহায়তা পাইনি। বাচ্চাদের পেছনে অনেক খরচ। এখন খাবারই জোটে না। বাচ্চাদের পুষ্টিকর খাবার দেব কীভাবে? এভাবে চলতে থাকলে তো না খেয়ে মারা যাব।'

২০১৮ সালে নড়িয়া পৌরসভার ২ নম্বর ও ৪ নম্বর ওয়ার্ড, কেদারপুর ইউনিয়ন ও মোক্তারের চর ইউনিয়নের আটটি গ্রাম ভাঙনের কবলে পরে। ওই সময় ভাঙনের শিকার হয় অন্তত সাড়ে ছয় হাজার পরিবার। যার মধ্যে বিভিন্ন সময় ৫ হাজার ৮১ পরিবারকে স্থানীয় প্রশাসন নানাভাবে সহায়তা করেছে। করোনা–দুর্যোগে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ থেকে উপজেলা প্রশাসন ২৬৯ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল ও ২০০ করে টাকা দিয়েছে। তবে এর অধিকাংশই দেওয়া হয়েছে ভাঙনের শিকার পরিবারের বাইরের শ্রমজীবীদের।

স্থানীয় সাংসদ ও পানি সম্পদ উপমন্ত্রী কে এম এনামুল হক শামীম পৌরসভায় ৭০০, কেদারপুর ইউনিয়নে ৪০০ ও মোক্তারের চর ইউনিয়নে ৩০০ পরিবারের মধ্যে চাল, ডাল, তেল, আলু ও সাবান দিয়েছেন। আর নড়িয়া পৌরসভার কর্মকর্তা, কর্মচারী, মেয়র ও কাউন্সিলরদের বেতনের একটি অংশ থেকে ৩ লাখ টাকা দিয়ে ১২০০ পরিবারকে চাল ও ডাল দেওয়া হয়েছে।

পৌর মেয়র শহীদুল ইসলাম বলেন, 'আমরা নতুন একটি সংকট মোকাবিলা করছি। সবাই ঘরবন্দী। আমরা কেউ জানি না কী আছে আমাদের সামনে। খেটে খাওয়া মানুষ, নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। সরকারি ত্রাণ সহায়তা খুবই অপ্রতুল। ভাঙন কবলিতদের জন্য ত্রাণের বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া প্রয়োজন।'

জানতে চাইলে নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জয়ন্তী রুপা রায় বলেন, 'নড়িয়া উপজেলার সবগুলো ইউনিয়নে দুই দফায় ১৫০০ পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দিতে পেরেছি। যারা দিনমজুর শ্রেণির, তাঁরাই এ সহায়তা পেয়েছেন। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আলাদা করে সহায়তা দেওয়ার সুযোগ হয়নি। ওই এলাকার মানুষের চাহিদার কথা জেলা পর্যায়ে জানানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই তাদের মধ্যে যারা শ্রমজীবী, দিনমজুর; তাদের তালিকা করে সহায়তা দেওয়া হবে।'