সারা দেশে জনবলের চার গুণ পিপিই বিতরণ

চিকিৎসাসেবায় ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর (পিপিই) ব্যবহার আগেও ছিল। জীবাণুর সংক্রমণ ও রাসায়নিক থেকে সুরক্ষার জন্য স্বাস্থ্য ও ল্যাবরেটরির কর্মীরা এটা ব্যবহার করেন। করোনার সংক্রমণের এই সময়ে বিশ্বজুড়ে এই সামগ্রীর ব্যবহারের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।

দেশে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সাড়ে চার লাখের বেশি পিপিই বিতরণ করেছে সরকার, যা সরকারি স্বাস্থ্য জনবলের চার গুণ বেশি। তবে করোনার চিকিৎসায় সম্মুখসারির এসব কর্মীর সবাই এই সামগ্রী পাননি। পিপিইর মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীসহ মোট ৬০ জন কাজ করেন। ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন এ উপজেলায় পিপিই পাঠিয়েছেন ৫৫টি। স্বল্পসংখ্যক পিপিই দিয়ে কীভাবে কাজ চালাবেন, জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হবে। আল্লাহ ভরসা।’

অনেক উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের পরিস্থিতি এ রকম। নবাবগঞ্জের পাশের কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও পিপিইর স্বল্পতা আছে। পাশাপাশি এই দুই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা একাধিক ব্যক্তির কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, পিপিইর কোনো সংকট নেই। গতকাল সোমবার নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, এ পর্যন্ত ৪ লাখ ৫৬ হাজার ১৭৪টি পিপিই বিতরণ করা হয়েছে। দেশের সব সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে পিপিই পাঠানো হয়েছে।

কোনো কোনো স্বাস্থ্যকর্মী পিপিই পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, পিপিই ব্যবহারের বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন আছে। কোথাও করোনায় আক্রান্ত রোগী থাকলে বা সন্দেহভাজন থাকলে পিপিই পরতে হবে। অন্য কাজে পিপিই ব্যবহার করা যাবে না। পিপিই ছাড়া বহির্বিভাগে রোগী দেখা যাবে না, এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন বলে না। যে জায়গায় পিপিই ব্যবহার যুক্তিপূর্ণ, সেখানেই ব্যবহার করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য অনুয়ায়ী, দেশের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীসহ মোট জনবল আছে ১ লাখ ১১ হাজার ৩০০ জন। এর মধ্যে চিকিৎসক ২৫ হাজার ৬১৫ জন, নার্স ৩৩ হাজার এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী ৫২ হাজার ৬৮৫ জন।

চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য বিভাগের সব কর্মীকে সমান ভাগ করে দিলে প্রত্যেকের কমপক্ষে চারটি করে পিপিই পাওয়ার কথা। কিন্তু তাঁরা তা পাননি। এ অভিযোগ আছে বিভিন্ন জেলায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এই জরুরি সময়ে সরবরাহে ন্যায্যতা থাকা জরুরি। যার প্রয়োজন, তার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

গতকাল দুপুরে ঢাকার শেরেবাংলা নগর এলাকার একটি হাসপাতালের একজন সিনিয়র স্টাফ নার্স প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁকে পিপিই হিসেবে এক সেট গাউন ও পাজামা দেওয়া হয়েছে। সেগুলো অতিসাধারণ কাপড় দিয়ে তৈরি। পানি ঢাললে চুইয়ে পড়ে।

পিপিইর মান নির্ধারণ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কোন ধরনের কাপড় দিয়ে তৈরি হবে, তা–ও বলে দিয়েছে। এই কাপড় দিয়ে কোনো তরল ভেদ করতে পারবে না। জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তরল ভেদ করলে তার মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের সুযোগ থাকে, সে কারণে পিপিইর কাপড় তরলরোধী হতে হয়।’

তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী কত পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে, সেই হিসাব সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চেয়ে পাওয়া যায়নি।

সুরক্ষার অন্য গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী মাস্ক। নাক ও মুখের সুরক্ষায় মাস্ক ব্যবহার করতে হয়। বিশ্বজুড়ে এন৯৫ মাস্ককে সবচেয়ে মানসম্পন্ন সুরক্ষাসামগ্রী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চিকিৎসকেরাও এই মাস্ক ব্যবহার করে নিরাপদ বোধ করেন। কিন্তু এই মাস্ক নিয়ে কিছু দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

একটি দেশি কোম্পানির মাস্ককে ‘এন৯৫’ নাম দিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা সিডিসির তথ্য অনুযায়ী, বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম কণা আটকে দেয় এন৯৫ মাস্ক। এটি খুবই সূক্ষ্ম কণা কমপক্ষে ৯৫ শতাংশ ফিল্টার করতে পারে। এটি ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসও ফিল্টার করতে সক্ষম। কিন্তু ১ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ঔষধাগার থেকে সরবরাহ করা মাস্কের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক শহিদ মো. সাদিকুল ইসলাম।

পরদিন ২ এপ্রিল নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক শহীদউল্লাহ বলেছিলেন, সব মাস্ক ফেরত নেওয়া হবে। কিন্তু ফেরত নেওয়া হয়নি। ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করলে গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, এই মাস্ক সার্জিক্যাল মাস্কের মতো। পরলে তো কোনো ক্ষতি নেই।

অন্যান্য বিভাগের মতো সিলেট বিভাগে এই মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে। একজন কর্মকর্তা বলেছেন, অনেক চিকিৎসকই এই মাস্ক ব্যবহারে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, করোনাযুদ্ধের সম্মুখসারির যোদ্ধা হচ্ছেন চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাঁরা যদি সুরক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন, তাহলে সেবা দেওয়া থেকে দূরে থাকার ঝুঁকি থাকবে। তবে সবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উচ্চ মানের পিপিই দরকার নেই। যাঁর দরকার, তাঁরা যেন এটা পান।