নারায়ণগঞ্জে লকডাউন কাজ না দিলে কারফিউ লাগবেই

সেলিনা হায়াৎ আইভী। ফাইল ছবি
সেলিনা হায়াৎ আইভী। ফাইল ছবি

প্রথম আলো: লকডাউনে নারায়ণগঞ্জের প্রথম দিনের চিত্র কী? কারফিউ যে কারণে চেয়েছিলেন, সেটা অর্জিত হলো?

মেয়র: লকডাউন হয়েছে। কিন্তু পাড়ায়-মহল্লায় মানুষ এখনো হাঁটাহাঁটি করে। সচেতনতার অভাব আছে। নারায়ণগঞ্জ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। প্রতিটি মহল্লায় প্রচুর মানুষ। তারা যদি না শোনে, তাহলে তো সর্বত্রগামী হয়ে তাদের পক্ষে ভূমিকা রাখা কঠিন হবে।

প্রথম আলো: আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও লকডাউনের বিষয়টি এসেছে। সেনাসদস্যদের উপস্থিতি বা টহল কি বেশি চোখে পড়ছে?

মেয়র: আমি এখনো শহরে বের হইনি। তাই এই মুহূর্তে বলতে পারব না।

প্রথম আলো: এটিএন নিউজের একটি আলোচনায় এসেছে, কারফিউ চাইতে আপনার বিলম্ব ঘটেছে কি না?

মেয়র: না। জেলা প্রশাসনের কাছে দুই সপ্তাহ আগেই জানিয়েছিলাম। স্থানীয় প্রশাসন সাড়া না দেওয়ার কারণে আমি বাধ্য হয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। আমি ২২ মার্চ থেকেই নারায়ণগঞ্জে লকডাউন চাচ্ছিলাম।

প্রথম আলো: লকডাউন নয়, মানুষ ভালো বোঝে কারফিউ বা ১৪৪ ধারা। এমন কিছু করলে তা আরও কার্যকর হতো?

মেয়র: আমি আগেই বলেছি, নারায়ণগঞ্জ অতি ঘনবসতিপূর্ণ। তাই কারফিউ জারি করাটাই হয়তো সমীচীন হতো। আমি কিন্তু আমার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে লকডাউন বা কারফিউ দুটোই বলেছি। এখন এটা অনুধাবন করবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এখন যদি এখানে প্রতিদিনই পজিটিভ বাড়তে থাকে এবং লকডাউনেও অসচেতনতা থাকে, তখন হয়তো কারফিউ অবশ্যই দরকার হবে। এটি বাণিজ্যিক নগরী, নিতাইগঞ্জ থেকে সারা দেশে চাল-ডালের মতো প্রচুর কাঁচামাল যাচ্ছে, তাই এসবের সরবরাহ খোলা রেখেই যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

প্রথম আলো: দেশে প্রথম যাঁদের পরীক্ষা হয়, তাঁর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের লোক ছিলেন। তাঁরা ইতালি প্রত্যাগত। কী আশঙ্কায় কারফিউ চাইলেন?

মেয়র: কিন্তু তাঁদের ফল নেগেটিভ এসেছিল। আমার যে কিছুটা শঙ্কা ছিল সেটা হলো, যেহেতু রোগটি দ্রুত ছড়ায়, আমরা ঘনবসতিপূর্ণ, আর এখানকার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ ইতালি, চীন ও জাপানে থাকেন, আর ইপিজেড ও বিসিককে ঘিরেও বিপুলসংখ্যক বিদেশি ঘোরাঘুরি করেন, তাই সংশয় একটা ছিলই। আমরা তো বলতে পারি না, কে কোথা থেকে ছড়াবে। মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ খুব লাগোয়া থাকাটাও একটা ভয়ের কারণ। ইতালি বা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে অনেকেই আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে অবাধে ঘুরেছেন, বুঝতে পারেননি।

প্রথম আলো: এটা কি ঠিক যে গত মঙ্গলবার একজন গিটারবাদকের লাশ প্রায় ৯ ঘণ্টা রাস্তায় পড়ে ছিল? তাঁর করোনায় মৃত্যু নিশ্চিত?

মেয়র: তিনি গান গাইতেন। ৯ ঘণ্টা পড়ে থাকার কথা জানি না। তবে সকাল ৯টায় খবর পেয়ে ১২টার মধ্যে দাফন দিই। আমার বাড়ির পাশেরই ঘটনা। আমরা জানার সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টা করেছি কীভাবে ডিসপোজাল করা যায়। তাঁর লাশ তার মা-বাবা কেউ নেননি। সিটি করপোরেশনের লোক গেছেন। দু-তিনজনকে লাশ সরাতে রাজি করাতে পারি। আমার কাছে র‌্যাপিং ব্যাগ ছিল না। কবরস্থানে লাশ পেতে কোনো ভ্যানগাড়ি পাচ্ছিলাম না। আমাদের নিজেদের লোকেরাই কবর খনন করেন। পাইকপাড়ায় গোসল করিয়ে তাঁকে দাফন করি।

তবে করোনায় মৃত্যু কি না, বলতে পারব না। সিভিল সার্জন অফিস দাফনের আগে তার নমুনা সংগ্রহ করেছে। ফল জানি না। আর সিভিল সার্জন নিজেই এখন আইসোলেশনে আছেন।

প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে কমিটি আছে, সেটা কীভাবে কাজ করছে? আপনি কীভাবে যুক্ত? পরিস্থিতি মোকাবিলায় দরকারি সামগ্রীর জোগান কেমন?

মেয়র: ৬ এপ্রিল রাত ৯টায় ডিসি, এসপি, সিভিল সার্জনস, সেনা প্রতিনিধিসহ আমরা একটি সভায় বসেছিলাম। সেখানে লকডাউন, টহল বৃদ্ধি, লাইন ধরে ত্রাণ বিতরণে ঝুঁকি প্রভৃতি নিয়ে কথা হয়। লাশ বহনের জন্য এসপির কাছে থেকে আমি ২০টি ব্যাগ পেয়েছি। ডিজি হেলথের সঙ্গে কথা হয়েছে। একটি টেস্টিং ল্যাব বসানোর কথা বলেছি। তিনি অগ্রাধিকার দেবেন বলে জানিয়েছেন। আমরা পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করেই কাজ করছি।

প্রথম আলো: তাহলে করোনায় বা করোনা সন্দেহে কেউ মারা গেলে তার দাফন ভালোভাবে হবে?

মেয়র: আমরা সব দায়িত্ব ভালোভাবে পারব, তা বলা দুরূহ। কারণ আমার ২৭টি ওয়ার্ড। তিন-চারটি জায়গায় ব্যবস্থা করে রেখেছি। আজ একটু আগেই (বিকেল ৫টা) জামতলায় একটি দাফন হয়েছে। বয়স ৭। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের এলাকা এটি। সিম্পটম ছিল ঠান্ডা, কাশি। তার আত্মীয়স্বজন আসেননি। আমাদের লোক পিপিই পরেই লাশ দাফন করেছেন। তবে সে করোনায় আক্রান্ত ছিল কি না, জানি না। এ রকমটা বাড়লে কিন্তু একটা কমান্ডিং বাহিনীর দরকার হবে। আমরা সব চাপ নিতে পারব না। আজ শুনলাম রেশন কার্ড আমাদেরই করতে হবে। চাল-ডালের বিতরণ আমরাই করছি। কাউন্সিলররা সক্রিয় আছেন। তাঁদের সুরক্ষা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। ব্যক্তিগতভাবে পিপিই সংগ্রহে উদ্যোগী হয়েছি। হাতে এলেই তাঁদর দেব। যাঁরা দাফনে, কবর খননে থাকবেন, তাঁদেরও তো পিপিই দিতে হবে। সিভিল সার্জনের দপ্তর নাকি ১০০০ পিপিই পেয়েছে।

প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জের ডেপুটি কমিশনারের প্রেশার বেড়েছে, তিনি বিশ্রামে, সদর উপজেলার ইউএনও হোম কোয়ারেন্টিনে?

মেয়র: আমি নিশ্চিত নই। আমি এটা বলব, যেহেতু এটা মোকাবিলার প্রাথমিক ধাপে আছি, অনেকের মধ্যেই একটু ভয়, রাগ কাজ করছে। এসব কাটিয়ে আমরা নিশ্চয় সম্মিলিতভাবে কাজ করতে পারব। একে অন্যকে দোষারোপ করার সময় এটা নয়। সাহসের সঙ্গে কমিউনিটি ও দেশের জন্য একত্রে কাজ করতে হবে।

প্রথম আলো: ওই সভায় ওষুধ সরবরাহ বা শুধু করোনা রোগীদের জন্য ঢাকার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের মতো বিশেষায়িত কোনো হাসপাতাল খোলার আলোচনা হয়েছে?

মেয়র: না। তবে আমি ডিসি, ডিজি হেলথ এবং সিভিল সার্জনকে একটা প্রস্তাব দিয়েছি। লোকালয় থেকে দূরে জাপানিরা ৩০০ শয্যার একটি হাসপাতাল করে দিয়েছিল। সেই হাসপাতালটিকে করোনা হাসপাতালে রূপান্তর করা যেতে পারে। আমার প্রস্তাবের পর এ বিষয়ে অগ্রগতির কথা জানি না।