দুর্গতিতে পোশাকশ্রমিকেরা: বর্তমান নিরুপায়, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

করোনার কালেও পেটে ভাত দিতে হয়। পেট অনেকগুলো। ‘দেশে’ দুটি ছোট মেয়ে, বুড়ো মা আর শ্বশুর। ঢাকায় নিজে আর স্বামী। ‘কামাইকাজের লোক’ শুধু স্বামী-স্ত্রী দুজন। 

দুজন গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীতে একই কারখানায় কাজ করেন। ৩১ মার্চ কাজের শেষে শ্রমিকদের বেতন দিয়ে কারখানাটি বন্ধ হয়। তাঁরা সেদিনই দেশে চলে যান। 

৫ এপ্রিল কারখানা খোলার কথা ছিল। মোসাম্মাত রাবেয়া বেগম সেদিন সকালে স্বামীর সঙ্গে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নবীনর গ্রাম থেকে টঙ্গী ফিরে আসেন। এসে কারখানা বন্ধ পান। 

সেদিনই দুপুর ১২টার দিকে পাগাড় সোসাইটির মাঠ এলাকায় তাঁদের ভাড়া বাসায় আমার সঙ্গে রাবেয়ার দেখা। বললেন, ওভারটাইমসহ দুজনে মিলে মাসে কমবেশি ২০ হাজার টাকা আয় করেন। তাই দিয়ে গ্রামের আর এখানকার দুই সংসার চলে। 

রাবেয়া বলেন, আগের রাতে ট্রাকে করে, পায়ে হেঁটে, বহু কষ্টে ফিরেছেন—‘একদিন অ্যাবসেন্ট করলে যদি আমাদের বাইর কইরা দেয়, তয় তো করার কিছু নাই।’ ছুটি আরও বাড়বে জানলে এখন তাঁরা ফিরতেন না।

পথে পথে পুলিশ গাড়ি থামিয়েছে। ড্রাইভার বাড়তি টাকা নিয়েছেন। টাকা লেগেছে ২ হাজারের মতো। মার্চের বেতন থেকে বাড়িতে টাকা দিয়েছেন। গাড়িভাড়া দিয়ে হাতে এখন টাকা নেই। রাবেয়া বলেন, ‘আর তো খাওয়ার মতো তৌফিক নাই ঘরে।’

টঙ্গীরই পূর্ব গোপালপুর এলাকায় স্বামী আর ছোট ছেলেকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন মোসাম্মাত নাজমা আক্তার। তিনি আর তাঁর স্বামী দুজনই পোশাকশ্রমিক। 

নাজমা বলেন, ৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে জেনে ২৫ মার্চ তাঁরা বগুড়ার শেরপুরে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। এপ্রিলের গোড়ায় সরকার সাধারণ ছুটি বাড়াল। নাজমা ভেবেছিলেন, তাঁদের ছুটিও বাড়বে।

নাজমার কথায়, ‘একটা মসজিদে যদি ১০০ জন লোক একসাথে যাইতে সরকার থেইকা নিষেধ করা হয়, তাইলে একটা গার্মেন্টসে দুই-তিন হাজার লোক কেমন করে কাজ করবে?’

নাজমা জানতেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে পোশাক কারখানা খোলা রাখা যাবে। তবু তিনি ৩ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, সরকার অথবা কারখানার মালিকের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করেন। 

এদিকে অফিসে ব্যবস্থাপকদের ফোন করলে তাঁরা তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেন। ‘মালিক যদি খোলা রাখে, আর এই সময় যদি চাকরি চলে যায়, এই ভয়ে আমার বাধ্য হয়া জীবনের ঝুঁকি নিয়াই আসছি’—বলেন নাজমা।

৪ এপ্রিল রাতে টঙ্গী ফিরে নাজমা শোনেন, বিজিএমইএ কারখানা বন্ধ রাখতে অনুরোধ করছে। তাঁর প্রশ্ন, ‘এই যে আমাদের একটা ভোগান্তি, গ্রামে যারা ছিল, তারা বাড়িতেই ছিল, লক্ষ লক্ষ মানুষ যে আবার ঢাকা শহরে আইল, এটা কি বিজিএমইএ কিংবা সরকারের একটা জ্ঞানহীনতার পরিচয় না?’

কিন্তু প্রশ্নটা কি নিছক জ্ঞানহীনতার? প্রভাবশালী কারও হেলাফেলা আর স্বার্থচিন্তার চূড়ান্ত প্রকাশও কি এটা নয়? 

বাণিজ্যমন্ত্রী পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি। গত প্রায় ২০ দিনে বিজিএমইএ ও নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ একাধিকবার কারখানা খোলা রাখার পক্ষে সায় দিয়েছে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকেও একাধিকবার এই বার্তা গেছে যে সুরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করাসহ জরুরি প্রয়োজনে কড়াকড়িভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খোলা রাখা যাবে। 

অবশেষে মালিকদের সংগঠন দুটিও ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখার সুস্পষ্ট যৌথ ঘোষণা দিয়েছে। বলেছে, সংগঠনকে জানিয়ে কেবল পিপিই বানানো আর জরুরি রপ্তানি ক্রয়াদেশের কাজ চলতে পারবে। 

যাক। আমরা ধাপে ধাপে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিশ্বাসী। আজ মনে হলো এতটুকু করি, কাল মনে হলো কড়াকড়ি আরেকটু বাড়াই। ছুটি বাড়াই দুদিন করে করে। করোনাভাইরাসকে ধাপে ধাপে বরণ করি অথবা অল্পে অল্পে কুলার বাতাস দিয়ে তাড়াতে চাই। 

এদিকে করোনা-বন্ধ বা লকডাউন না চললেও রাবেয়া এখন দেশে ফিরতে পারতেন না। তাঁর মার্চের বেতন শেষ, দোকানে বাকি পাওয়া অনিশ্চিত। তিনি বলেন, ‘এই যে বন্ধের পর বন্ধ দিতাছে, সামনের স্যালারি পাব কি না, হের তো কোনো নিশ্চয়তা নাই।’

এসে থেকে শুনছেন, কারখানার কাজের আদেশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে। কারখানা চলবে কি না, সেটা জানা তাঁর বড় দরকার। তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টস ছাড়া তো আমাদের কিছু নাই। বাড়ি যায়া করব কী?’ মালিকেরা কী করেন, সেই আশাতেই থাকতে হবে। 

নাজমাও অপেক্ষা করছেন। প্রথমত, মার্চের বেতনের জন্য। দ্বিতীয়ত, তিনি শুনেছেন, সরকার তিন মাসের বেতন-ভাতার জন্য সাহায্য দেবে। কীভাবে কখন তা পাবেন, সেটা জানতে চান। 

বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ ১৬ এপ্রিলের মধ্যে মার্চের বেতন দিয়ে দিতে সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুরোধ করেছে। টঙ্গী থেকে ফিরে রাতে ফোন করি বিজিএমইএর সহসভাপতি আরশাদ জামালকে। তিনি বললেন, বেশির ভাগ কারখানা শ্রম আইনের ১৬-এর ২ ধারায় কাজ বন্ধ করেছে। 

এতে করে শ্রমিকেরা লে-অফের নিয়মে বন্ধের পর ৪৫ দিন পর্যন্ত বেতন-ভাতা পাবেন। বাড়িভাড়া, চিকিৎসাভাতা ও খাদ্যভাতা পুরোপুরি, আর মূল বেতনের অর্ধেক। কারখানা যদি আরও অন্তত ১৫ দিন বন্ধ থাকে, তবে শ্রমিকেরা মূল বেতনের এক-চতুর্থাংশ এবং ভাতাগুলো পাবেন। তবে আইন বলছে, সে ক্ষেত্রে মালিক আইনের ২০ ধারায় প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে ছাঁটাইও করতে পারবেন। 

আরশাদ জামাল বলছেন, কারখানা কাজ হারিয়ে পথে বসতে নিলে তেমন ছাঁটাই হতে পারে। বন্ধ অত দিন গড়ালে কারখানাগুলোর কাজে অন্য রকম জট লেগে যাবে। 

মালিকেরা কিন্তু আরও আগে থেকেই এসব সমস্যার কথা বলে সরকারের কাছ থেকে সুবিধা চেয়ে আসছেন। সরকার একাধিক আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণাও করেছে। এগুলোর একটি হচ্ছে রাবেয়া নাজমাদের মতো শ্রমিকদের জুন পর্যন্ত তিন মাস বেতন দেওয়ার জন্য বাণিজ্যিক ঋণসুবিধা। 

এই ঋণ পেতে হলে প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত বেতন দেওয়ার এবং রপ্তানি চলমান থাকার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। ঋণদাতা ব্যাংক সরাসরি বেতনের টাকাটা শ্রমিকের ব্যাংক অথবা মোবাইলের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেবে। বেতন ধরা হবে আগের তিন মাসের গড় বেতনের নিরিখে। 

কথাবার্তা বলে যা বুঝলাম, শিল্পমালিকেরা এই ঋণ ও বেতন দেওয়ার পথটি খুব সহজ বলে ভাবছেন না। পরিশোধ করতে হবে, সেটা একটা জটিলতা। লে-অফের নিয়মে আধা বেতন না কি তিন মাসের গড় বেতনের সমপরিমাণ, সে নিয়েও একটা বাহাস লেগে যেতে পারে। 

তা ছাড়া বদলি বা সাময়িক শ্রমিকেরা কিন্তু এসব কোনো সুযোগের দাবিদার হবেন না। শুনলাম, তেমন শ্রমিকেরা এখনই ছাঁটাই হচ্ছেন। বড় কারখানার পাশাপাশি ঠিকা ছোট কারখানাতেও অনেক শ্রমিক কাজ করেন। এগুলো বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকবে।

এটা ঠিক যে করোনার আসর মালিকদের রেয়াত দেবে না। তবে সরকারের কাছে দেনদরবার করার পথ তাঁদের সর্বদা খোলা থাকে। রাবেয়া বা নাজমার গলা কার কানেই-বা পৌঁছাবে?