সক্ষমতা থাকলেও করোনায় পরীক্ষা হচ্ছে কম

ছবিটি প্রতীকী। ছবি: রয়টার্স
ছবিটি প্রতীকী। ছবি: রয়টার্স

বর্তমানে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মোট ১৭টি ল্যাবরেটরিতে করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। এসব ল্যাবরেটরিতে দিনে সাড়ে চার হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা থাকলেও এখন পর্যন্ত দিনে পরীক্ষা হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৩ শ পর্যন্ত। সক্ষমতার বেশিরভাগই অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ এবং ল্যাবরেটরি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে যারা নমুনা সংগ্রহ করার জন্য প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব রয়েছে। আবার যারা আছেন তারাও যথেষ্ট প্রশিক্ষিত না। তাদের হাতে–কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। অনলাইনে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া সেটা যথেষ্ট নয়। ফলে পর্যাপ্ত নমুনা সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। অনেকক্ষেত্রে সঠিক প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ না করায় কিছু নমুনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার বর্তমানে যে পদ্ধতি (পিসিআর) ব্যবহার করে শনাক্তকরণের পরীক্ষা করা হচ্ছে সেটি বেশ জটিল। এই পরীক্ষা করার মতো দক্ষ টেকনিশিয়ানেরও সংকট রয়েছে। ফলে দেশি–বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বেশি বেশি পরীক্ষা ও রোগী শনাক্তের তাগাদা দিলেও সক্ষমতার এক–তৃতীয়াংশই ব্যবহারও করা যাচ্ছে না।

এর বাইরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে অনেকে নমুনা দিতে চাচ্ছেন না, পরীক্ষা কম হওয়ার এটা বড় কারণ।

দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ১ হাজার ৩৪০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে নতুন রোগী শনাক্ত হন ১৩৯ জন। একদিনে পরীক্ষা এবং আক্রান্তের হিসেবে দুটিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। করোনা পরীক্ষার ১৭টি ল্যাবের মধ্যে ঢাকায় ৯টি ও বাকি ৮টি ঢাকার বাইরে। এসব ল্যাবের পুরো সক্ষমতা ব্যবহার করলে প্রতিদিন আক্রান্তদের শনাক্ত হওয়ার সংখ্যা আরও বাড়বে। এ জন্য পরীক্ষার পরিসর বাড়ানো, নমুনা সংগ্রহকারী ও টেকনিশিয়ানের সংখ্যা বাড়ানো এবং তাদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রশিক্ষিত লোকবলের সংকট

ঢাকার একটি ল্যাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষার কাজে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সন্দেহভাজন ব্যক্তির নাকের শ্লেষা একটি কাঠির (সোয়াপ স্টিক) মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহকারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় শ্লেষা ঠিকমতো সংগ্রহ হয় না। আবার সংগ্রহ করা নমুনা সঠিক পদ্ধিতে সংরক্ষণ ও পরিবহন না করায় তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এমন ঘটনাও আছে।

ঢাকার বাইরে খুলনা মেডিকেল কলেজে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার কার্যক্রম শুরু হয়েছে ৭ এপ্রিল। এখানে জনবল আছে ১৩ জন। এর মধ্যে একজন টেকনোলজিস্ট ছাড়া আর কারোরই এই পরীক্ষা করার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। এখানে গতকাল রোববার পর্যন্ত ছয়দিনে মোট ১২৭টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। অথচ এখানে দিনে ৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা রয়েছে।

খুলনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল আহাদ প্রথম আলোকে বলেন, যারা পরীক্ষাগারে কাজ করছেন তাদের তেমন অভিজ্ঞতা নেই। এ কারণে পরীক্ষা করতে দেরি হচ্ছে। সঠিকভাবে নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে না পারার কারণে অনেক নমুনা নষ্টও হয়ে যাচ্ছে।

উপজেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ সঠিকভাবে হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের (বিআইটিআইডি) পরীক্ষাগারের দায়িত্বে থাকা সহযোগী অধ্যাপক শাকিল আহমেদও। এ ছাড়া তাঁর ল্যাবে আটজন টেকনোলজিস্ট নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে সব কাজ করে। এ ছাড়া অনেক ‘ম্যানুয়েল ওয়ার্ক’ থাকে। ফলে পরীক্ষা করতেও সময় লাগে।

চট্টগ্রামের বিআইটিআইডিতে ২৬ মার্চ থেকে কোভিড–১৯ পরীক্ষা চালু হয়। গতকাল পর্যন্ত ১৮ দিনে মোট পরীক্ষা হয়েছে ৫৮৭ টি নমুনা। অথচ এখানে দিনেই ৯৪টি নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা আছে।

চিকিৎসা নিতে আসা সন্দেহভাজন রোগীদের মধ্য থেকে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করছে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। বিএসএমএমইউ গত ১২দিনে ৩০৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি দৈনিক ৯৩ জনের পরীক্ষা করতে পারে।

বিএসএমএমইউর ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহ মুন্সী প্রথম আলোকে বলেন, আটজন টেকনিশিয়ান নমুনা সংগ্রহ করছেন। আর পরীক্ষার কাজটি চিকিৎসকদের করতে হচ্ছে। করোনা পরীক্ষার জন্য অনলাইনে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তা হাস্যকর। হাতেকলমে প্রশিক্ষণ ছাড়া কারও পক্ষে এ ধরনের পরীক্ষা করা প্রায় অসম্ভব।

বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজে গত বুধবার পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়ার দুদিনের মাথায় করোনা পরীক্ষাগারে (ল্যাব) স্থাপিত যন্ত্রে ত্রুটি দেখা দিয়েছে। একটি যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন করা হলেও এর পরীক্ষার সক্ষমতা কমে গেছে। ল্যাবটিতে একসঙ্গে ৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। বরিশালে করোনাভাইরাস পরীক্ষার গবেষণাগার স্থাপন হলেও তা পরিচালনার জন্য বিশেষজ্ঞ ভাইরোলজিস্ট এবং দক্ষ টেকনোলজিস্ট দেওয়া হয়নি।

বরিশাল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অসিত ভূষণ দাস প্রথম আলোকে বলেন, ল্যাবের জন্য জনবল চাওয়া হয়েছিল, এখনো পাওয়া যায়নি।

সক্ষমতার তুলনায় পরীক্ষা কম
শুরু থেকে কোভিড-১৯ রোগের পরীক্ষা করে আসছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা গত দুই মাসে একাধিকবার সাংবাদিকদের বলেছেন, দিনে এক হাজার নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা তাঁর প্রতিষ্ঠানের আছে। কিন্তু আইইডিসিআর এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২৭৬টি নমুনা পরীক্ষা করেছে। তবে সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষা করেছে ২০৯ টি।

ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিনের দিনে ৫০০ নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা আছে। ৩১ মার্চ থেকে গতকাল পর্যন্ত ১৩ দিনে ৫৫০ জনের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করেছে। অথচ, সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করা হলে এখানে ১৩ দিনে সাড়ে ছয় হাজারের ওপরে পরীক্ষা করা সম্ভব ছিল।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের সঙ্গে যৌথভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনও কোভিড-১৯ পরীক্ষার দায়িত্ব পেয়েছে। দিনে তাদের দুই শ নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা আছে। গত ১৩দিনে পরীক্ষা করেছে ৩৩৯ টি নমুনা পরীক্ষা করেছে।

আইইডিসিআরের সংগ্রহ করা নমুনা ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভস (আইদেশি) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশকে (আইসিডিডিআরবি) দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে আইদেশি এখন পর্যন্ত ৩১৭ এবং আইসিডিডিআরবি ৬১৯টি পরীক্ষা করেছে। আইদেশির দৈনিক ৪৫০টি এবং আইসিডিডিআরবি দৈনিক ৭০০ নমুনা পরীক্ষা করতে পারে।

নমুনা কম, তাই ঢাকার বাইরেও পরীক্ষা কম
রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআর একটি ল্যাবরেটরি করেছিল কক্সবাজার সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেই ল্যাবে গত ১ এপ্রিল থেকে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হচ্ছে। এখানে দিনে ৯৬টি নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা থাকলেও গত ১২ দিনে ১৪৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। নমুনা সংগ্রহের জন্য কোনো যানবাহন নাই।

কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অনুপম বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, নমুনা সংগ্রহ কম হচ্ছে বলেই সংখ্যাটা একটু কম। বিচ্ছিন্ন উপজেলা মহেশখালী ও কুতুবদিয়া থেকে নমুনা আসছে কম।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে ১ এপ্রিল পরীক্ষা শুরু হলেও গতকাল পর্যন্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ৫২২টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এখানে দৈনিক ৯৪ জন রোগীর নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। ল্যাবের ইনচার্জ অধ্যাপক সালমা আহমেদ বলেন, নমুনা কম আসায় সক্ষমতার তুলনায় পরীক্ষার সংখ্যা প্রায় অর্ধেক।

রাজশাহীতে গত ১ এপ্রিল থেকে পরীক্ষা শুরু হলেও এখন পর্যন্ত ৩৯০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই ল্যাবে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করা যায়। পরীক্ষাগারের ইনচার্জ সাবেরা গুলনেহার বলেন, দিন দিন নমুনার সংখ্যা বাড়ছে। বেশির ভাগ নমুনা আসছে বগুড়া আওতাভুক্ত অঞ্চল থেকে।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি ও ভাইরোলজি বিভাগে ৭ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে করোনা পরীক্ষা। গতকাল পর্যন্ত ৩০৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। ল্যাব স্থাপনের পূর্বে এই মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ময়নুল হক বলেছিলেন, পরীক্ষাগারটিতে দিনে ১৯২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। তিনি গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, করোনার পরীক্ষাটা সময়সাপেক্ষ। এছাড়া কিছু কারিগরি সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে পরীক্ষা করা হচ্ছে। বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হলে করোনা পরীক্ষা যন্ত্রে ‘লোড’ বেশি হয়ে যায়।

দিনে ৯০টি নমুনা পরীক্ষা করার সক্ষমতা নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজে কভিড-১৯ পরীক্ষা করা হচ্ছে ২ এপ্রিল থেকে। তবে গতকাল পর্যন্ত ৪১৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। রংপুর মেডিকেলের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান মোস্তাকিমুর রহমান বলেন, বিভিন্ন উপজেলার ও জেলা শহরের হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আগত রোগীর উপসর্গের ওপর নির্ভর করছে পরীক্ষা।

তবে সোসাইটি অব ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্টের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান এ এন নাসিমউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বর্তমানে যে পদ্ধতিতে (পিসিআর) করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা করছে তা ব্যয়বহুল ও বিশেষায়িত। এই পদ্ধতির নমুনা সংগ্রহ ও যন্ত্র পরিচালনার মতো প্রশিক্ষিত ও দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে। সরকার সেরোলজিক্যাল প্রক্রিয়ায় র‍্যাপিড ডিটেকশন টেস্টের মাধ্যমে পরীক্ষার সুযোগ দিলে সহজে সারা দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]