বিষণ্ন মনে দেখছি ভবিষ্যতের ছবি

আমি ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে ছিলাম। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষার সামনে এসে মনে হচ্ছিল, কোনোভাবে যদি পরীক্ষাটা এড়ানো যেত! জানুয়ারি মাসে যখন চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল, তখনো সেখানে মৃত্যুর হার নগণ্য, অন্তত বাংলাদেশে আমাদের কাছে। এ দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার এর চেয়ে ঢের বেশি। প্রাণ হাতে নিয়ে যাঁরা ঢাকার রাস্তায় বের হন, তাঁদের কাছে চীনের করোনার হুমকি তখনো তেমন আর কী!

সে সময়টায় ভাবতাম, যদি কোনোভাবে পরীক্ষাটা পিছিয়ে যেত! আর হ্যাঁ, এইচএসসি পরীক্ষা এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত। এখন ভাবছি, আমি কি সত্যিই এটা চেয়েছিলাম? মনে হচ্ছে, করোনা মোকাবিলা করার তুলনায় পরীক্ষার ভয় জয় করা তো অতি তুচ্ছ।

অফিস, স্কুল কিংবা বাসায় কারও কাজের তাড়া নেই। দিন শুরু হয় দেরিতে। সারা দিন সবকিছু চলতে থাকে ঢিমেতালে। চোখ সেঁটে থাকে টেলিভিশন সংবাদ আর চলমান ব্রেকিং রিপোর্টের শিরোনামে। কোন দেশে কত লোক আক্রান্ত হলো, কতজন প্রাণ হারাল, আর কত লোক সুস্থ হলো—এসব জেনে নিতে নিতেই ১০টা সাড়ে ১০টা বেজে যায়। এবার অপেক্ষা বাংলাদেশের পরিস্থিতির জন্য। দুপুরের দিকে জানানো হয় এটা।

নাশতাটা খেয়ে পড়তে বসি। পরীক্ষা তো হবেই একদিন না একদিন। কিন্তু টেবিলে বসলেও মনটা পড়ায় বসে না। মনে হয়, পড়া সব ভুলে গেছি। পড়ার ইচ্ছাটাও কেমন হারিয়ে ফেলেছি। নিরুদ্বিগ্ন শান্তিপ্রিয় আমার এই ছোট্ট জীবনে কখনোই মৃত্যুভয় তেমন করে মনে উঁকি দেয়নি। আর আজ প্রতিটা দিনের আলো যেন আরেকটা দিন না দেখার সংশয় নিয়ে কাছে পৌঁছায়। প্রতিটা দিন বিষণ্নতা আর ভয়ে ভরা।

আঠারো বছর বয়সে কেউ নিজের প্রাণের ভয় পায় না, কিন্তু স্বজন হারানোর ভয় তো ঠিকই আসে। বাবা ডায়াবেটিসের রোগী। তা ছাড়া গত বছর তাঁর বাইপাস সার্জারি হয়েছে। বাবাকে নিয়েই আশঙ্কায় দিন কাটে আমাদের। এ রকম আরও কত পরিবার, কত মানুষ যে ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছে!

এখন মায়ের বকুনি নেই। যতবার যতক্ষণ খুশি মুঠোফোন চালাই, মায়ের কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। পড়তে যাওয়ার জন্যও বকাবকি করে না। খেতে ইচ্ছা করে না। ক্ষুধাই তো লাগে না। সারাটা দিন যেন স্তব্ধ এক জীবনের প্রতিচ্ছবি।

তবু আজ ঘুম থেকে উঠে মনে হলো, একটু বারান্দায় গিয়ে আকাশটা দেখি। আকাশের বিশালতার মধ্যে নতুন একটা ভাবনা খুঁজে পেলাম—এই পৃথিবীর বুকে কীভাবে বেঁচে আছি আমরা। রুদ্ধ হয়ে আছে আমাদের উৎপাদন। কাজ নেই, অনেকের রোজগার নেই। তবু আমাদের জীবনধারণ চলছে। কোনো ব্যয় থেমে থাকছে না। প্রতিমুহূর্ত অনিশ্চয়তায় কাটছে, তবু মানুষ ভবিষ্যতের ছবি আঁকছে মনে। সেই ভবিষ্যতের ছবিটা ধু–ধু মরুভূমির প্রান্তরের মতো। হয়তো সেখানে মরূদ্যান আছে, হয়তো নেই। তবু ভবিষ্যৎই মানুষের অবলম্বন।

এইচএসসি পরীক্ষার্থী, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা