'এমন বৈশাখ, এমন রমনা, এই জীবনে দেখিনি'

ঘুমের ঘোরে ছোট্ট শারমিন ইসলাম বলে ওঠে, ‘বাবা, আজ তো পয়লা বৈশাখ। আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে রমনায় ঘুরতে যাব। দুই হাতে পরব লাল চুড়ি। পরব আমি লাল পাড়ের সাদা রঙের শাড়ি।’

শারমিনের কথা শুনে বাবা আতিকুল ইসলাম মন খুব খারাপ হয়ে গেল। শারমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আপন মনে আতিকুল বলে ওঠেন, ‘এবার বৈশাখে আমরা ঘুরতে যেতে পারব না, মা। আমরা বাসায় থাকব। বাসায় বৈশাখ উদযাপন করব। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে আমাদের ঘরে থাকতেই হবে।’

বছর ঘুরে আবার এসেছে পয়লা বৈশাখ। প্রকৃতি সেজেছে নিজস্ব রূপে। গাছে গাছে নতুন পাতা। বৈশাখের প্রথম দিনে সারা দেশের মানুষ আজ ঘরবন্দী। ঘরে বসেই মানুষ যার যার মতো পয়লা বৈশাখ উদ‌যাপন করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রধান ফটকে ফুটেছে ফুল। ছবি: আসাদুজ্জামান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রধান ফটকে ফুটেছে ফুল। ছবি: আসাদুজ্জামান

মীর জাহিদুল হক ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। পয়লা বৈশাখে প্রতিবছর তাঁর ছেলেমেয়েকে নিয়ে রমনার বটমূলে আসতেন। দিনভর ঘোরাঘুরি করতেন। নিজেদের মতো সময় কাটিয়ে চলে যেতেন বাসায়।

মীর জাহিদুল হক আজও এসেছেন রমনায়। তবে ঘুরতে নয়। শাহবাগ থেকে ওষুধ কিনে দুপুর ১২টার দিকে রমনা পার্কের সামনে দিয়ে হাঁটতে থাকেন।

জাহিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ পয়লা বৈশাখ। আজকের রমনা পার্ক দেখার পর আমার মন খারাপ হয়ে গেছে। বুঝতে শেখার পর পয়লা বৈশাখে রমনা পার্ক এমন নির্জন কোনো দিন দেখিনি। পয়লা বৈশাখে রমনা পার্ক প্রতিবছর যেমন থাকে, আজও ঠিক তেমনই আছে। কিন্তু রমনায় মানুষ নেই। করোনাভাইরাসের ভয়ে মানুষ আছে সব ঘরে।’

রমনা পার্কে ঢোকার সব প্রবেশপথ বন্ধ। রমনা পার্কের পাহারায় আনসার বাহিনীর সদস্যরা। ভেতরে আর কেউ নেই।

রমনা পার্ক প্রকৃতি সেজেছে নিজের রূপে। ছবি: আসাদুজ্জামান
রমনা পার্ক প্রকৃতি সেজেছে নিজের রূপে। ছবি: আসাদুজ্জামান

পয়লা বৈশাখের রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে রমনার বটগাছে বসে হরেক রকমের পাখি। যে যার সুরে ডাক দিয়ে চলেছে। বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ। পার্কের ভেতর ফুটে আছে নানা রঙের ফুল। পার্কের চারপাশের সড়কেও মানুষের আনাগোনা নেই। কিছুক্ষণ পরপর আওয়াজ তুলে দু-একটি ব্যক্তিগত গাড়ি ছুটে চলেছে যে যার গন্তব্যে।

অথচ পয়লা বৈশাখের এই দিনে রমনার ভেতর ভুভুজেলার আওয়াজে চারপাশ মুখর থাকত। মুখে থাকত প্রিয় সব গান।

রাজশাহী থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজকের রমনা পার্ক দেখে বোঝার উপায় নেই, আজ পয়লা বৈশাখ। বাঙালির সব থেকে আনন্দের দিন। এই রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চারুকলা চত্বর দেখে মনে হয়, মানুষ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা তো জানি, করোনাভাইরাসের আতঙ্কে মানুষ আছে সব ঘরে। করোনার হাত থেকে বাঁচার জন্য সবাই ঘরে বসেই পয়লা বৈশাখ উদযাপন করছেন।’

পয়লা বৈশাখে রমনা পার্কের সকল প্রবেশপথ বন্ধ। ছবি: আসাদুজ্জামান
পয়লা বৈশাখে রমনা পার্কের সকল প্রবেশপথ বন্ধ। ছবি: আসাদুজ্জামান

পয়লা বৈশাখে প্রতিবছর চারুকলা অনুষদের আয়োজনে সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। করোনাভাইরাসের কারণে এবার মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টারে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ উপন্যাসের সংলাপ ‘মানুষ ধ্বংস হতে পারে, কিন্তু পরাজিত হয় না’ স্লোগানটি তুলে ধরা হয়েছে।

পয়লা বৈশাখে চারুকলা অনুষদের চত্বর মানুষের পদচারণে মুখর থাকত। চারুকলার সামনের দেয়াল নতুন আলপনায় সেজে উঠত। আজ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দেখা গেল, চারুকলা অনুষদের প্রধান ফটক বন্ধ।

তখন নূর ইসলাম নামের এক লোক ত্রাণের মালামাল ব্যাগ করে নিয়ে চারুকলার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন।

নূর ইসলাম বলেন, ‘এমন পয়লা বৈশাখ, এমন রমনা এই জীবনে দেখিনি। এই সময়ে চারুকলার সামনে কত মানুষ থাকত, আনন্দ করত। অথচ আজ এখানে মানুষ নেই, মানুষ আছে সব ঘরে।’ কবে আবার মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে তা নিয়ে বড়ই চিন্তিত নূর ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কাজ নেই। ঘরে টাকা নেই। কীভাবে সংসার চালাব, বুঝতে পারছি না।’