চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের বাসা ছাড়তে বলছেন অনেক বাড়িওয়ালা

ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি করেন সাবিহা সুলতানা। রমনার একটি বাসায় তিনি ভাড়া থাকতেন। দুদিন আগে ওই হাসপাতালের দুজন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। এরপর কম্পিউটার অপারেটর সাবিহা সুলতানাকে ডেকে নিয়ে বাসা ছেড়ে দিতে বলেন বাড়িওয়ালা।

সাবিহা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘রমনা এলাকার একটি বাসায় আমি এবং আরেকজন নারী ভাড়া থাকতাম। দুদিন আগে আমাদের হাসপাতালের দুজন ডাক্তারের করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। কাজ শেষে গতকাল মঙ্গলবার রাতে আমি বাসায় ফিরি। তখন বাড়িওয়ালা আমাকে ডেকে নেন এবং বলেন, আজ রাতেই যেন আমি বাসা ছেড়ে দিই। তখন আমি বললাম, সকালেই আমি বাসা ছেড়ে চলে যাব। পরে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় আমি চলে এসেছি।’

হেলাল উদ্দিন আহমেদ। ফাইল ছবি
হেলাল উদ্দিন আহমেদ। ফাইল ছবি

ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক সিরাজউদ্দিন। তিন দিন আগে জানতে পারেন, তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। বর্তমানে একটি হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি রয়েছেন।
সিরাজউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজধানীর শান্তিনগর এলাকায় নিজের ফ্ল্যাটে আমি বসবাস করি। পেশাগত কাজে আমাকে প্রতিদিন বাড়ির বাইরে আসতে হয়। হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা দিতে হয়। রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে আমার করোনা ভাইরাস পজিটিভ। আমার স্ত্রী, আর দুই সন্তান ফ্ল্যাটে অবস্থান করছে। ঘর থেকে তাঁরা বের হয় না। তবুও আমি এবং আমার পরিবারের সদস্যরা অন্য ফ্ল্যাট মালিকদের চরম দুর্ব্যবহারের শিকার।’

কেবল এই দুজন স্বাস্থ্যকর্মী নন, ঢাকা মহানগরসহ সারা দেশের বহু চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ জরুরি সেবায় নিয়োজিত পেশার মানুষ অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন। 

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আতঙ্কে বাড়িওয়ালা, ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দারা তাঁদের বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য চাপ তৈরি করছেন। নানা প্রকারের কটূক্তিও করছেন।

ময়মনসিংহে এক নারী চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্তের পর অনেক জোর করেই তাঁদের বাসা থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। হাসান নামের একজন চিকিৎসক ফেসকুকে লিখেছেন, তাঁকে বাড়িওয়ালা বাসা ছাড়তে বলেছেন। এমন ঘটনা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। কেউ জানাচ্ছে কেউ বা চুপ করে আছেন।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি চিকিৎসক মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি চিকিৎসক মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি চিকিৎসক মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়িওয়ালারা বাসায় রাখতে চাইছেন না। সারা দিন চিকিৎসা সেবা দিয়ে যখন একজন স্বাস্থ্যকর্মী বাসায় যাচ্ছেন, তখন বাড়িওয়ালা হুমকি দিচ্ছেন, বাসায় থাকতে পারবেন না। অনেকে থাকতে পারছেন না বাসায়। অনেক বাড়িওয়ালা বলছেন, আপনি করোনাভাইরাসের টেস্ট করে আসেন। আপনার করোনা হয়েছে কি না নিশ্চিত হন, ইত্যাদি নানা কথা বলছেন।

এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বুধবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালে যাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন, যাঁরা করোনা নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের সঙ্গে অনেক বাড়িওয়ালা খারাপ ব্যবহার করছেন বলে শুনেছি। যেসব বাড়িওয়ালা খারাপ ব্যবহার করবেন, বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেবেন, তাঁদের ব্যাপারে প্রশাসনকে জানাতে বলা হয়েছে।’

অমানবিক, অন্যায় আচরণ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) একজন চিকিৎসকের দেহে সম্প্রতি করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ে। এই খবর পাওয়ার পর তাঁর ভাড়া বাসায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন স্থানীয় লোকজন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ওই চিকিৎসক।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ফাইল ছবি
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ফাইল ছবি

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি হাসপাতালের একজন চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে ভবনে থাকি, সেই ভবনের আমাদের একজন সহকর্মীর করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। ওই ভবনে আরও কয়েকজন চিকিৎসক থাকেন। স্থানীয় লোকজন তখন ওই বাসায় তালা ঝুলিয়ে দিতে উদ্যোগী হন, খুবই খারাপ আচরণ করেন। পরে প্রশাসনের লোকজন বাসাটি লকডাউন ঘোষণা করে।’

মানুষের এই ধরনের আচরণের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক চিকিৎসক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসক, নার্সসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কোনো কোনো স্বাস্থ্যকর্মী বাসা থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে, রূঢ় আচরণের শিকার হচ্ছেন। একসময় মানুষ মনে করতেন, ফ্ল্যাটে একজন ডাক্তার থাকলে অনেক সহায় হবে। কিন্তু তাঁরাই আবার মনে করছেন, ফ্ল্যাটে একটা ডাক্তার থাকা মানে ঝুঁকি। এই মনোভবের কারণ, করোনাভাইরাস সম্পর্কে আমাদের কুসংস্কার বা স্টিগমা। সেখান থেকে এই রূঢ় আচরণ করছেন বাড়িওয়ালা কিংবা ফ্ল্যাটের অন্য লোকজন। আমরা জানি, কীভাবে করোনাভাইরাস ছড়ায়। তারপরও আমাদের অনেকে অন্যায় আচরণ করছেন।’

রাজধানীর বেসরকারি একটি হাসপাতালের ল্যাব টেকনোলোজিস্ট জুয়েল হোসেনকে গতকাল বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় ভাড়া থাকতেন তিনি।


জুয়েল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যে হাসপাতালের ল্যাবটেকনোলোজিস্ট, সেই হাসপাতালের চার-পাঁচজনের করোনাভাইরাস পজিটিভ ধরা পড়েছে। এই খবর শুনে বাড়িওয়ালা আমাকে আর বাসায় ঢুকতে দেননি। বাধ্য হয়ে আমি এখন অন্যত্র বসবাস করছি।’

স্বাস্থ্যকর্মীসহ জরুরি সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের সঙ্গে যেসব লোকজন এই ধরনের অন্যায় আচরণ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আইনজ্ঞরা।

এ এম আমিনউদ্দিন। ফাইল ছবি
এ এম আমিনউদ্দিন। ফাইল ছবি

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাউকে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার জন্য বাধ্য করা যাবে না। কেউ যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন, তখন তিনি আইসোলেশনে থাকবেন। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মীসহ কাউকে যদি চলে যেতে বলা হয়, রূঢ় আচরণ করা হয়, সেটা বেআইনি। ডাক্তার, নার্স, পুলিশসহ জরুরি সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা তো আর শখে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। তাঁরা তো মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য সরকারি নির্দেশনায় কাজ করছেন। এসব মানুষকে যাঁরা হয়রানি করছেন, তাঁরা সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ করছেন।’

আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন মনে করেন, ‘চিকিৎসক, নার্সসহ যেসব স্বাস্থ্যকর্মী সিভিল সার্জন কিংবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অধীনে কাজ করছেন, তাঁদের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। যেসব স্বাস্থ্যকর্মীকে বাসায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না অর্থাৎ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন, যা অপরাধ।’

চিকিৎসাসেবাসহ জরুরি সেবায় যাঁরা নিয়োজিত, যাঁরা রূঢ় ও অন্যায় আচরণের শিকার হচ্ছেন, তাঁদের কথা শোনার হটলাইন নম্বর চালুর পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। ফাইল ছবি
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। ফাইল ছবি

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই বিশেষ পরিস্থিতিতে এ অন্যায় আচরণ প্রতিরোধ করার জন্য যথেষ্ট আইনি সুযোগ রয়েছে। সংক্রামক আইনে সরকারকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে যেসব ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করছেন, তাঁদের বাসা থেকে চলে যাওয়ার যে চাপ দেওয়া হচ্ছে , এটি প্রতিরোধের জন্য সরকার সংক্রামক আইন অনুযায়ী একটি নির্দেশনা জারি করতে পারে, এই ধরনের কাজগুলোকে করা যাবে না। যাঁরা করবেন, তাঁরা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করবেন। কোনো বাড়িওয়ালা কিংবা অন্য কেউ যদি চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীর কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন, তা জানানোর জন্য দ্রুত হটলাইন চালু করা দরকার। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও গণসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসক নার্সসহ জরুরি সেবায় নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি যদি অন্যায় আচরণের শিকার হন, যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনেন, তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’