ফোন দিলেই নিজের গাড়িতে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি

প্রসববেদনায় কাতরাচ্ছিলেন গৃহবধূ মর্জিনা বেগম। পুরো এলাকায় ঘুরেও কোনো গাড়ি কিংবা অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজ পেলেন না স্বজনেরা। কোনো উপায় না পেয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি স্ট্যাটাস দেখে ফোন দিলেন মো. মহিউদ্দিনকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হালিশহর থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে এই তরুণ হাজির হলেন গৃহবধূর বহদ্দারহাটের বাসায়। পৌঁছে দেন হাসপাতালে। কয়েক ঘণ্টা গড়াতেই ওই নারীর কোলজুড়ে আসে শিশুকন্যা।
এই মহিউদ্দিন হলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে অবস্থিত নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একজন কর্মী। করোনাভাইরাসের কারণে গাড়িশূন্য হয়ে পড়ার এই সময়ে রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে যিনি হয়ে উঠেছেন শহরের মানবিক মুখ। গত ১০ দিনে তিনি ৩০ জনের বেশি অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন। আবার কাউকে কাউকে পুনরায় বাসায়ও ফিরিয়ে দিয়েছেন। এসব কিছুই করছেন একদম বিনা ভাড়ায়।
মহিউদ্দিনের মনে এমন সেবা দেওয়ার মানসিকতার উৎপত্তি আসলে এক নারীর অসহায়ত্ব দেখে। ৪ এপ্রিল আগ্রাবাদের বড়পোল এলাকায় একটি ব্যাংকে সেবা নিতে যান তিনি। ফেরার সময় দেখেন, এক অসুস্থ নারীকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সড়কে দাঁড়িয়ে আছেন আরেক নারী। কিন্তু ওই নারীর শারীরিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে কিছুক্ষণের মধ্যেই সড়কে লুটিয়ে পড়েন। সড়কে কোনো গাড়িও ছিল না তখন। পরে কোনোরকমে একটি গাড়ি জোগাড় করে ওই নারী হাসপাতালে পৌঁছান।
চোখের সামনে সেই দুর্ভোগ দেখে আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেননি মহিউদ্দিন। ওই দিন রাত ৭টা ২২ মিনিটে নিজের ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন তিনি। নিজের ঠিকানা ও মুঠোফোন নম্বর দিয়ে ঘোষণা দেন, ‘কোথাও যদি কোনো রোগীর গাড়ির প্রয়োজন হয়, আমি নিজে গিয়ে হাসপাতালে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসব। গাড়ি ভাড়া দিতে হবে না।’ মুহূর্তেই সেই স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর থেকে মহিউদ্দিনের কাছে আসতে থাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধের ফোন। প্রতিদিন গড়ে তিন-চারজন রোগীকে তিনি হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছেন।
মহিউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাকরির পাশাপাশি তিনি বন্ধুদের সঙ্গে যৌথ ব্যবসা করেন। এ ছাড়া তাঁর ভাড়ায় চালিত প্রাইভেট কার আছে। সেই গাড়িকে এখন কাজে লাগিয়েছেন মানবসেবায়। বেশির ভাগ সময়ই নিজে রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটছেন। নিজের ব্যস্ততা থাকলে পাঠাচ্ছেন চালককে। গাড়ির খরচের জন্য নিজের বেতন থেকে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ রেখেছেন তিনি।
সেবা পাওয়া কয়েকজন এবং তাঁদের আত্মীয়ের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের একজন আশিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘‌‌আমার শ্বশুর ফখরুল আলম ডায়াবেটিসের রোগী। তাঁর দুটি কিডনিতেই সমস্যা থাকায় মাসে কয়েকবার চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল ডায়ালাইসিস করতে হয়। কিন্তু করোনার কারণে কোনোভাবেই গাড়ি পাচ্ছিলাম না। তাই মহিউদ্দিন ভাইকে ফোন করি। এমন সহযোগিতা পাব কখনো কল্পনা করিনি। অনেক চেষ্টা করলাম ভাড়া দিতে, তা–ও নিলেন না।’
মহিউদ্দিন বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে এখন তাঁর কর্মস্থলেও রোগীর সংখ্যা কম। ফলে অনেকটা সময় অবসর পাচ্ছেন। আর রাতে তো কোনো কাজ নেই। তাই দিনে অফিসের ফাঁকে এবং রাতে যেকোনো সময়ে রোগীদের তিনি নিজের গাড়ি করে হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছেন।
করোনা–আতঙ্কে যখন যেকোনো রোগীকে এড়িয়ে চলতে চাইছে, সেখানে আপনি তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর উৎসাহ কোথায় পেলেন এমন প্রশ্নে মহিউদ্দিন বলেন, ‘এই কঠিন সময়ে মানুষের পাশে তো দাঁড়াতেই হবে।’
এখন মহিউদ্দিনের ফেসবুক ভরে উঠেছে সেবা পাওয়া অনেকের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মন্তব্যে। অবশ্য এতে আবেগে ভেসে যাচ্ছেন না তিনি। বলেন, ‘যত দিন না সমস্যা কাটছে, তত দিন মানুষকে এভাবেই সহযোগিতা করে যাব। গাড়ির প্রয়োজন হলে নির্দ্বিধায় ফোন করুন।’