চিকিৎসক-নার্সদের বের করে দিলে ডিএনসিসির সেবা পাবেন না বাড়িওয়ালারা

যেসব বাড়িওয়ালা ডাক্তার, নার্স কিংবা স্বাস্থ্যকর্মীকে বাসা থেকে বের করে দেবেন, তাঁদের কোনো ধরনের সেবা দেবে না ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।

ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘যেসব ডাক্তার, নার্স, যাঁরা আমাদের সেবা দেন, তাঁদের যদি বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়, তাহলে সেই সব বাসাবাড়ির মালিককে সিটি করপোরেশন কোনো ধরনের সার্ভিস দেবে না।’

করোনাভাইরাসের বিস্তার ও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধিসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মেয়র আতিকুল ইসলাম এসব কথা বলেন।

ডাক্তার, নার্সসহ জরুরি সেবার সঙ্গে যুক্ত অনেককে বাসা থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে উল্লেখ করে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই, যাঁরা বাসা থেকে লোক বের করে দিচ্ছেন, সেসব বাসাবাড়িতে সিটি করপোরেশনের কোনো ধরনের সার্ভিস আমরা দেব না। ডাক্তার, নার্স এবং যেসব কর্মী ত্রাণের কার্যক্রমের সঙ্গে আছেন, প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন, কাজে ঘর থেকে বের হচ্ছেন, তাঁদের যেসব বাড়িওয়ালা বা অন্য ব্যক্তিরা সহযোগিতা করবেন না, এটা কিন্তু হবে না। আমি যদি অভিযোগ (কমপ্লেইন) পাই, ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে ক্লিয়ার মেসেজ, তাঁদের আমরা সকল ধরনের সিটি সার্ভিস থেকে বঞ্চিত করব এবং সেই বাড়িতে যদি কোনো ময়লা থাকে, আমার সিটি করপোরেশনের কোনো কর্মী বা স্টাফ সেই বাড়িতে যাবেন না সেই ময়লা নেওয়ার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে আমি অনুরোধ করব, ঢাকার বিদ্যুৎ বিভাগ, ডেসকো, ওয়াসা যেন সেসব বাড়ির পানির লাইন এবং ইলেকট্রিক লাইন বন্ধ করে দেয়। যাঁরা মানবতার পেশায় আছেন, যাঁরা আমাদের রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা করছেন, তাঁদের সঙ্গে এ কেমন আচরণ। এটা কী ধরনের মানবতা।’

দেশের এই ক্রান্তিকালে জরুরি সেবার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে মেয়র আতিক বলেন, ‘ডাক্তারদের পাশাপাশি পুলিশ ভাইয়েরাও সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মাঠে সেবা দিচ্ছেন আর্মির সদস্রা, র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যাঁরা বিত্তবান আছেন, তাঁদের আমি অনুরোধ করব, আপনারা আপনাদের মতো সাহায্য-সহযোগিতা করেন। অনেক পরিবার কিন্তু মুখ খুলে চাইতেও পারছেন না।’

মেয়র বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, করোনার এই ধরনের সমস্যা কিন্তু আমরা কোনো দিন মোকাবিলা করিনি। আমি দেখিনি, আমার বাবা-দাদারাও দেখেনি। আমরা সাংঘাতিক একটা হুমকির মধ্যে আছি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন একটা হটলাইন চালু করেছে। যদি কোনো ডাক্তার কিংবা নার্স সেবা দিতে গিয়ে কোনো ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়েন, আমাদের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের যে হটলাইন আছে, সেই হটলাইনের মাধ্যমে অভিযোগ জানান। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আপনার পাশে আছে। পাশে থাকব আমরা। যেকোনো সমস্যা হলে আমাদের হটলাইনে আমাদের জানাতে পারেন অথবা আমার মোবাইল ফোনেও আপনার সমস্যা জানাতে পারেন। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব আপনাদের পাশে থাকার।’

ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের যেসব সরকারি হাসপাতাল আছে, সেগুলোর যেকোনো ধরনের সমস্যার কথা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে জানাতে বলেন মেয়র আতিকুল।

মেয়র বলেন, ‘আমাদের কুর্মিটোলা হাসপাতাল আছে, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল আছে। প্রথম অবস্থায় কিছুটা অব্যবস্থাপনা ছিল। এখন কিন্তু ভালো আছে। কুর্মিটোলা হাসপাতালে একজন পরিচালক আছেন, যিনি ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালেও একজন ব্রিগেডিয়ারকে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, তাঁর সঙ্গেও কথা বলেছি। যদি কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে আমাদের সিটি করপোরেশনকে বলা হোক। কুর্মিটোলা হাসপাতাল বলেছিল, তাদের স্প্রে মেশিন নেই। আমি সঙ্গে সঙ্গে মেশিন সরবরাহের ব্যবস্থা করেছি। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলেছি। যদি কোনো ধরনের সমস্যা হয়, আপনারা আমাদের জানান। অবশ্যই আমাদের সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব আপনাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। ছবি: আসাদুজ্জামান
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। ছবি: আসাদুজ্জামান

বাসায় বাসায় গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫০০টি করে প্যাকেট দিয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে ৩ লাখ কেজি চাল আমরা সরকারের কাছ থেকে পেয়েছি। ২০ লাখ টাকার ত্রাণ পেয়েছি। বিভিন্ন কাউন্সিলরের মাধ্যমে বাসায় বাসায় ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরপর আমরা যে ত্রাণ পাব, তা বস্তিবাসীকে দেওয়া হবে। কার্ড সিস্টেম চালু করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আমাদের কাউন্সিলদের নির্দেশ দিয়েছি, সিটি করপোরেশনের একটা হটলাইন চালু করা আছে, বিশেষ করে যাঁরা রিলিফ নিতে আসবেন না, তাঁরা ফোন করলে তাঁদের ঘরে রিলিফ পৌঁছে দেওয়ার জন্য।’

ডেঙ্গু নিয়ে ভয়
ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে সতর্ক আছেন বলে জানান মেয়র আতিকুল। তিনি বলেন, ‘সিঙ্গাপুরে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুর প্রভাব আমরা দেখছি। গতবার যেসব দেশে ডেঙ্গুর প্রভাব ছিল, সেসব দেশেও ডেঙ্গুর প্রভাব শুরু হয়েছে। এডিস মশার ডিম কিন্তু তিন বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। পানি আসার পর সেখান থেকে আবার মশা তৈরি হয়। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা জানি, ডেঙ্গু মশার জন্ম পরিষ্কার পানিতে, কোনো ড্রেনে হয় না। বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে মশার জন্মস্থান ধ্বংস করছি। সবাই মিলে এগিয়ে আসতে হবে। তিন দিনের মধ্যে এক দিন পানি ফেলে দিন।

গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন
মেয়র আতিকুল বলেন, ‘আমারও গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে। আমিও বিজিএমইএর সভাপতি ছিলাম। মালিকেরা কিন্তু দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে আছে, এটাই বাস্তবতা। বায়াররা বলছে, তাদের মাল নেবে না। আমরা কিন্তু ভালো অবস্থার মধ্যে নেই। আমাদের কিন্তু বেতন দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। প্রধানমন্ত্রী পোশাকশিল্পকে ভালোবাসেন। যার কাছে আমরা মালটা বিক্রি করব, সব দেশে কিন্তু লকডাউন। কেউ কিন্তু গার্মেন্টসসামগ্রী কিনছেন না। এর প্রভাব ফ্যাক্টরির ওপর পড়েছে, শ্রমিকদের ওপর পড়েছে।’

বেতন দেওয়া প্রসঙ্গে মেয়র আতিক বলেন, ‘আজকের ভেতরে (১৬ এপ্রিল) সবার বেতন দিয়ে দেওয়া হবে। শ্রমিকদের অনুরোধ করব, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত, মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ না করা পর্যন্ত কেউ যেন ঘর থেকে বের না হন। শ্রমিকদের বেতন অনলাইনে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। মার্চ মাসের বেতন দিতে অনুরোধ করব। বড় গার্মেন্টস বেতন দিয়েছে, কিছু ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান এখনো দেয়নি।’

ভেন্টিলেশনের অভাব
করোনার চিকিৎসায় দেশে ভেন্টিলেশনের অভাব আছে জানিয়ে মেয়র আতিক বলেন, ‘আমারই যে ভেন্টিলেশন লাগবে না, সেটা কিন্তু আমি জানি না। ভেন্টিলেশন আমদানি করার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিরলসভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু সারা বিশ্বে এখন ভেন্টিলেশনের অভাব। আমাদের দেশে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ভেন্টিলেশন বানাতে পারে, কিছু কোম্পানি বানানোর চেষ্টা করছে, তাদের ধন্যবাদ। বিত্তবানদের বলব, আপনারা এগিয়ে আসুন ভেন্টিলেশন আমদানির জন্য। আমরাও চায়নার সঙ্গে কথা বলছি, কীভাবে ভেন্টিলেশন কীভাবে প্রাইভেটভাবে আমদানি করা যায়। ভেন্টিলেশনের অভাবে কোনো রোগী যাতে মারা না যায়, সে ব্যাপারে সরকার যেমন দেখবে, বিত্তবানরাও এগিয়ে আসবেন বলে আশা করি।’

হাসপাতাল খোলা রাখতে হবে
ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের সব হাসপাতাল খোলা রাখার অনুরোধ করেছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বারবার অনুরোধ করেছেন, যাঁর যাঁর হাসপাতাল আছে, তাঁরা যেন হাসপাতাল না বন্ধ করেন। যেন সার্ভিস দেওয়া হয়। সরকারের তরফ থেকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছি কিন্তু সার্ভিস দেওয়ার জন্য। এই সময়ে করোনার ভয়ে যদি হাসপাতাল রোগীর পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে এটা সবার মধ্যে ভীতি তৈরি করবে। সব হাসপাতালের মালিকদের অনুরোধ করব, আপনারা হাসপাতাল যেন বন্ধ না করেন। সব হাসপাতাল খোলা রাখতে হবে। করোনাভাইরাস শুধু না, আরও বহু রোগ কিন্তু মানুষের আছে। এই মহামারির সময়ে আপনারা সেবা দিন। অবশ্যই এই সেবা কিন্তু আমরা মনে রাখব। আমরা সিটি করপোরেশন কিন্তু মনিটরিং করছি। কারা কারা রোগী ফেরত দিচ্ছে, তাদের সঙ্গেও কিন্তু সেই ধরনের আচরণ করা হবে। হাসপাতাল খোলা রেখে আরও বেশি সেবা দেবেন।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট নয়
বর্তমানে সিটি করপোরেশনের বিদ্যমান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা রয়েছে, তা যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস কিন্তু বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। আমাদের একটা প্ল্যাটফর্ম আছে। সি-ফোর্টি। বিশ্বের ১২০ জন মেয়রের সঙ্গে কথা বলার উদ্যোগ শুরু করেছি। ৪০ জন মেয়রের সঙ্গে কথা হয়েছে। বিভিন্ন মেয়র কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সে ব্যাপারে আমরা আলোচনা শুরু করেছি। এই আলোচনা চলমান থাকবে। বিভিন্ন মেয়রের ভালো যেসব উদ্যোগ আছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা চলছে। কথা হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালির, স্পেনের মেয়রের সঙ্গে। আমরা তথ্য বিনিময় করছি। দুর্যোগের সময় ব্যবস্থাপনার দিকে এগিয়ে আসতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার যে ব্যবস্থা বিদ্যমান, তা মোটেও যথেষ্ট না।’