'করোনার সময়ে ছেলেটা কাছে নাই, ভয় লাগে'

প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে কলেজপড়ুয়া এক ছেলে প্রায় তিন মাস ধরে টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে রয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই সময় ধারণক্ষমতার বেশি শিশু রয়েছে কেন্দ্রটিতে। তাই বেশ উদ্বিগ্ন ১৭ বছর বয়সী ছেলেটির মা। এই মা বললেন, ‘করোনার এই সময়ে ছেলেটা কাছে নাই। অনেক ভয় আর কষ্ট লাগে। চোখের দেখাটাও দেখার সুযোগ নাই। ফোন করলেও ওইখানের লোকজন রাগারাগি করে, তাই ফোন করতেও ভয় লাগে। শুধু আমি না, আমার এলাকার অন্য ছেলেদের বাবা-মায়েরও একই অবস্থা।’

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশের তিনটি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে ১ হাজার ১৪২ শিশু অবস্থান করছে। করোনাভাইরাসের বিস্তারের সময় অভিভাবকেরা উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকা সন্তান নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবে কেন্দ্রগুলোর দেখভাল করা সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, শিশুরা এখন পর্যন্ত ভালো আছে, উদ্বেগের কিছু নেই।

শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী আইনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িত বা সংস্পর্শে আসা শিশু বা অভিভাবকদের মাধ্যমে আসা শিশুদের উন্নয়ন ও স্বাভাবিক জীবনে একীভূত করার জন্য কেন্দ্রগুলো পরিচালিত হচ্ছে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কেন্দ্রগুলোতে শিশুদের উন্নয়নে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিনটি কেন্দ্রের মধ্যে গাজীপুরের টঙ্গী (বালক) ও কোনাবাড়ীতে (বালিকা) দুটি কেন্দ্র এবং আরেকটি যশোরের পুলেরহাটে (বালক)। তিনটি কেন্দ্রে আসনসংখ্যা ৬০০, তবে বর্তমানে নিবাসী শিশুর সংখ্যা এক হাজারের বেশি।

মুঠোফোনে কথা হয় শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকা কলেজপড়ুয়া ওই ছেলের মায়ের সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর ছেলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত নয়। ২০১৭ সালের যে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা বলা হচ্ছে, তখন ছেলে কোনো মুঠোফোন ব্যবহার করত না। একদিন রাত একটার সময় র‌্যাবের সদস্যরা দরজায় ধাক্কা দিয়ে ছেলেকে নিয়ে নিয়ে যান। পরের দিন সকালে ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন র‌্যাবের সদস্যরা। তবে ছেলে আর বাড়ি ফেরেনি। এই ছেলেসহ মোট পাঁচজনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল র‌্যাবের সদস্যরা। পাঁচজনের চারজনই আছে টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে।

ছেলেটির মা বলেন, উন্নয়ন কেন্দ্রে গিয়ে গত ২২ মার্চ ছেলের সঙ্গে শেষ দেখা করতে পেরেছিলেন। করোনাভাইরাসের বিস্তারের কারণে ছেলেকে কাছে আসতে দেয়নি কর্তৃপক্ষ, দূর থেকেই কথা হয়। ছেলের জন্য নেওয়া রান্না করা খাবারও কর্তৃপক্ষ দিতে দেয়নি করোনাভাইরাস বিস্তারের ভয়ে। ছেলে দূর থেকেই জানিয়েছিল তার অনেক সমস্যা হচ্ছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফোসকা পড়েছে। খাবার যা দেয়, তাও সে খেতে পারে না।

মাজেদা ফাউন্ডেশন নামে বেসরকারি একটি সংগঠন টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকা এই চার শিশুকে খাবার দেওয়াসহ বিভিন্ন সময় সহায়তা করেছে। করোনাভাইরাসের কারণে এখন সব ধরনের সাহায্য–সহযোগিতা নেওয়া বন্ধ রেখেছে উন্নয়ন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। মাজেদা ফাউন্ডেশনের সভাপতি তারেক মিয়াজী বলেন, উন্নয়ন কেন্দ্রটিতে মোট আবাসনের চেয়ে নিবাসীর সংখ্যা অনেক বেশি। করোনা বিস্তারের এই সময়ে এই শিশুদের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।
তবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সৈয়দ মো. নুরুল বাসির বলেন, উন্নয়নকেন্দ্রগুলোতে আবাসনের চেয়ে নিবাসীর সংখ্যা বেশি। কেন্দ্রগুলোতে জনবল–সংকটসহ অন্যান্য সমস্যাও আছে। তবে করোনাকালে নিবাসী শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বলছে, টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) মোট অনুমোদিত আবাসনের সংখ্যা ৩০০, তবে বর্তমানে নিবাসীর সংখ্যা ৬৯৭। করোনাভাইরাস বিস্তারে সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর নতুন নিবাসী এসেছে ১৮ জন। যশোরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) মোট আবাসন ১৫০, তবে বর্তমানে নিবাসী আছে ৩৩১ জন। নতুন যুক্ত হয়েছে আটজন। কোনাবাড়ী উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালিকা) মোট আবাসন ১৫০, তবে এ কেন্দ্রটিতে মোট আসনের চেয়ে কম নিবাসী আছে। নিবাসীর সংখ্যা ১১৪।

কোনাবাড়ী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের (বালিকা) তত্ত্বাবধায়ক (সহকারী পরিচালক) মুননাজ ইতি বলেন, এখানের নিবাসী মেয়েরা ভালো আছে। করোনাভাইরাস নিয়ে যাতে ভয় না পায়, সে জন্য প্রতিদিনই কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। একেকটি রুমে চারজন করে থাকছে মেয়েরা। বর্তমানে অনুমোদিত আসনের চেয়ে মেয়ের সংখ্যা কম থাকায় খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে না। ভবন পরিষ্কার রাখা, বিভিন্ন ফ্লোরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেওয়া, মেয়েদের মাস্ক দেওয়া, হালকা গরম লেবুপানি, সিভিট বা টক–জাতীয় ফল খাবার দেওয়াসহ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে।

মুননাজ ইতি জানান, জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সহায়তায় একজন চিকিৎসক সপ্তাহে দুই দিন নিবাসীদের দেখে যান। এ ছাড়া জরুরি প্রয়োজনে ডাকলেও আসেন। কেন্দ্রের নিজস্ব গাড়ি আছে, জরুরি প্রয়োজন হলে হাসপাতালে নেওয়া সমস্যা হবে না। করোনাভাইরাস বিস্তারের কারণে নিবাসীদের সঙ্গে অভিভাবকেরা সরাসরি দেখা করার সুযোগ পাচ্ছেন না। তবে টেলিফোনে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। বর্তমানে উন্নয়ন কেন্দ্রটিতে থাকা তিনজনের (হারিয়ে যাওয়া) বয়স ১০ বছর বয়সের কম। অন্যদের বয়স ১০ বছর থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের।

তবে এ উন্নয়ন কেন্দ্রে কর্মরত নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বললেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়ে আমরা বড়রাই ভয়ে অস্থির। ভিন্ন একটি পরিবেশে থাকা এখানকার শিশুরা তো ভয় পাবেই। তবে তারা যাতে ভয় না পায়, সে জন্য কাউন্সেলিং করা হচ্ছে।’

সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সৈয়দ মো. নুরুল বাসির বলেন, করোনার এই অবস্থা একটি বিশেষ পরিস্থিতি। নিবাসীদের মধ্যে যাদের আচরণ ভালো, বয়স ১৮ বছরের কাছাকাছিসহ বিভিন্ন দিক বিবেচনায় মুক্তি দেওয়া যায় কি না, তা আদালতের মাধ্যমে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও বিষয়টি পর্যালোচনা করার সুযোগ আছে।