চিনিকলের কাছে পাওনা সাড়ে ১৬ কোটি টাকা, বিপাকে কৃষক

রাজশাহী চিনিকলের কাছে কৃষকদের প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি টাকার পাওনা আটকে গেছে। টাকা না পেয়ে তাঁরা ফসলের পরিচর্যা করতে পারছেন না। করোনা পরিস্থিতির কারণে অন্য ফসল বিক্রি করেও তাঁরা টাকার জোগাড় করতে পারছেন না। এতে একমাত্র কৃষিকাজই যাঁদের অবলম্বন, তাঁরা বড় সংকটে পড়েছেন।

চিনিকল কর্তৃপক্ষ বলছে, এবার চিনির দাম ভালো আছে। শুধু করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে নানা ধরনের বিধিনিষেধ থাকায় চিনি বিক্রি করা যাচ্ছে না। এ কারণে কৃষকদের পাওনা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। তবে এ বিষয়ে কৃষকেরা বলছেন, অন্য চিনিকল আখের বকেয়া বিল দেওয়া শুরু করলেও রাজশাহী চিনিকল গত ২২ জানুয়ারির পর থেকে আর আখের বিল দেয়নি।

এদিকে শুধু চাষিদের পাওনাই নয়, চিনিকলের কর্মচারীদের বেতনও তিন মাস থেকে বন্ধ রয়েছে। একই কারণে কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছে এ জন্য থোক বরাদ্দ চেয়েছে। সেটিও পাওয়া যায়নি।

রাজশাহী চিনিকল সূত্রে জানা গেছে, এবার ২১ নভেম্বর থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চিনিকল চালু ছিল। ১ লাখ ৪৪ হাজার টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আখ পাওয়া গেছে ১ লাখ ২৯ হাজার টন। চিনি উৎপাদন হয়েছে ৮ হাজার ১৯ টন। অবিক্রীত চিনি রয়েছে ৫ হাজার ৫০০ টন। চিনির পাইকারি দাম ধরা হয়েছে ৬০ টাকা কেজি। এই হিসাবে প্রায় ৩৩ কোটি টাকার চিনি অবিক্রীত রয়েছে। এবার আখ চাষ ১৫ শতাংশ বেড়েছে। চিনিকল এলাকায় ১৩ হাজার ১০০ একর জমিতে আখ চাষ হয়েছে। গত ২১ নভেম্বর থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চিনিকল চালু ছিল। ২২ জানুয়ারির পরে এই চিনিকল থেকে কোনো চাষির আখের দাম পরিশোধ করা হয়নি।

আখের বিল না দেওয়ায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন প্রান্তিক কৃষকেরা। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা মিঞাপাড়া গ্রামের আখচাষি আজাহার আলী বলেন, তিনি চিনিকলের কাছে ৪০ হাজার টাকা পাবেন। এই টাকা থাকতে তিনি ফসলের পরিচর্যা করতে পারছেন না। তাঁর ঘরে মসুর ডাল রয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে বিক্রি করতে পারছেন না। বিক্রি করতে পারলে সেই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে পারতেন, ফসলের পরিচর্যা করতে পারতেন। কিন্তু টাকার অভাবে এখন কিছুই করতে পারছেন না।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী ক্রয়কেন্দ্রের চাষি তরিকুল ইসলাম বলেন, চিনিকলের কাছে তাঁর ১৬ লাখ ৬৯ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে। তাঁর ৫৪ বিঘা জমিতে আখ রয়েছে। এবার এক বিঘা জমিতেও সার, সেচ কিছুই দিতে পারেননি। খেত একেবারে জঙ্গল হয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি অসুস্থ, চিকিৎসা করানোর কোনো টাকা নেই। মানুষের কাছ থেকে ২৩ হাজার টাকা ধার করে তিনি নিজের চিকিৎসা করানোর জন্য রাজশাহীতে গিয়েছিলেন। তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের মরার মতো অবস্থা হয়ে গেছে। পাশের নাটোর, কুষ্টিয়ার চিনিকল চাষিদের টাকা দিলেও রাজশাহী চিনিকলই টাকা দিচ্ছে না।’

বাঘা উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের কৃষক আবদুল মালেক বলেন, চিনিকলের কাছে তাঁর প্রায় ৯ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। তিনি ৪০ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছিলেন। এই আখ কাটার এবং ক্রয়কেন্দ্রে পৌঁছানোর গাড়িভাড়া বাবদ তাঁর ২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এই টাকা তিনি দিতে পারেননি। শ্রমিকেরা তাঁকে প্রতিদিন বাড়িতে এসে অপমান করে যাচ্ছে। তাঁদেরও বিপদ। তাই মুখ বুজে তাঁকে সব অপমান সহ্য করতে হচ্ছে। এবারও তাঁর প্রায় ৪০ বিঘা জমিতে আখ রয়েছে। এবার আখের পরিচর্যা দূরের কথা, তাঁদের চাল কেনার মতো পয়সা নেই।

এ বিষয়ে রাজশাহী চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সেলিম বলেন, তাঁদের ধারণা ছিল শবেবরাত ও সামনে রোজার আগে চিনির চাহিদা বাড়বে। তাঁদের অবিক্রীত চিনি বিক্রি হয়ে যাবে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সব অচল হয়ে আছে। তাই চিনি বিক্রি করতে না পারায় এখন তাঁরা বিকল্প চিন্তা করছেন। সরকারের কাছে তাঁরা ২০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ চেয়েছেন। গতবার এই বরাদ্দ পেয়েছিলেন। এবারও আশা করছেন, পাবেন। ওই বরাদ্দ পেলে চাষিদের পাওনা ও কর্মচারীদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হবে।