ক্রান্তিকালে অন্নযোদ্ধা বাবার গল্প

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

করোনার করুণ লীলায় বিশ্ব এখন স্তব্ধ। চারদিকে অসহায়ত্বের হাহাকার! জীর্ণশীর্ণ হয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় রাজপ্রাসাদ, কারণ, করোনা মানুষকে একাকিত্বের শিক্ষা দিচ্ছে। সামনে নিয়ে এসেছে নতুন শব্দযুগল, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, লকডাউন!

বাংলাদেশেও এসেছে করোনা। দিনে দিনে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, মৃতের হার বাড়ছে তড়িৎগতিতে। এর নেই কোনো প্রতিষেধক ওষুধ, আছে শুধু এড়ানোর উপায়। থাকতে হবে একা, বন্ধুবান্ধব সব বাদ।

সরকার নানা ব্যবস্থা নিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বন্ধ দোকান, শপিং মলসহ সবকিছু। থমকে গেছে জীবনের চাকা, চারদিকে হাহাকার! পোশাক কারখানা বন্ধ থাকায় লাখো শ্রমিক বেকার, নেই কাজ। কারখানাগুলো বন্ধ, কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্যবঞ্চিত, কারণ, চারদিকে নির্জন, নেই ক্রেতা। এর মধ্যে বাবারা হন্যে হয়ে খুঁজছেন অন্ন! দুবেলা দুমুঠো অন্নের খোঁজে রাস্তায় দিগ্‌বিদিক ছুটছে ত্রাণ আর সাহায্যের জন্য। কারণ, তাঁরা এখন নিরুপায়। থমকে গেছে জীবন, আয়ের পথ বন্ধ! কিন্তু তাঁদের এ সংগ্রাম রয়ে যাবে অগোচরে।

হ্যাঁ, আমি এমন বাবার একজন নাড়িছেঁড়া সন্তান। কিন্তু আমার বাবার সংগ্রাম অন্য রকম, আজ আমি আপনাদের শেয়ার করব আমার বাবার করোনার দিনগুলোর যুদ্ধ আর প্রেরণার উৎসের কথা।

আমি বড় হয়েছি মধ্যবিত্ত পরিবারে। দুই ভাই, এক বোন, মা, বাবা—পাঁচ সদস্যের পরিবার আমাদের। বাবা পঙ্গু, বাবার পঙ্গুত্ব আমাদের জন্মের পর থেকে। দাদুর কাছ থেকে জেনেছিলাম কোনো এক চিকিৎসকের ছোট্ট ভুলের কারণে আব্বুর ডান পাটা কুঁকড়ে গেছে। বিস্তারিত অজানা। আমি পরিবারে মেজ সন্তান, আমার বড় এক ভাই আছে। বোনটি আমার ছোট, সবে ক্লাস সিক্সে পড়ে। পারিবারিক অসহায়ত্বের কারণে বড় ভাইটি লেখাপড়া তেমন করতে পারেননি, আব্বু পঙ্গু হলেও কখনো কোনো কিছুর অভাবে রাখেননি, ভাঙা পা নিয়ে পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছেন পাঁচ সদস্যের একটি সুখী পরিবার। দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, জোগান দিচ্ছেন আমাদের চাহিদার।

ও, বলা তো হয়নি আব্বু কী করেন। হ্যাঁ, আব্বু একজন কৃষক। বাপ-দাদার অল্প ভিটা আর পাহাড়ে অল্প সরকারি খাস জায়গায় চাষাবাদ করে চলছে আমাদের সংসার। আব্বু একজন দক্ষ পান চাষি, পান চাষে চলে আমাদের সংসার। পরিবারের অসচ্ছলতা দূর করতে বড় ভাইটিকে অল্প বয়সে দূর প্রবাসে পাঠানো হলো। এক বছর হচ্ছে ভাইয়ের প্রবাসজীবন, এখনো রয়ে গেছে ঋণের বোঝা। কিন্তু করোনার ধাক্কায় বিপর্যস্ত আমরা। একদিকে পানের বাজার একদম তলানিতে, তেমন দাম নেই। অন্যদিকে করোনার ধাক্কায় বড় ভাই পাঠাতে পারছেন না কোনো অর্থ। কারণ, তাঁর ভাষ্যমতে, সেখানে কারফিউ জারির কারণে বাসা থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে বলা যায়, ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’।

কিন্তু থেমে নেই বাবার সংগ্রাম। করোনা রোগী যখন বাংলাদেশে ধরা পড়ল, তখন আব্বু বুদ্ধি করে দুই বস্তা চাল বাড়িতে মজুত করলেন, যা দিয়ে অনায়াসে দুই মাস কেটে যাবে আমাদের। কিন্তু তরকারি কিনতে হয়, তাই একটু ঝামেলা। বাবা সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাতের মুচা নিয়ে পাহাড়ে চলে যান। ফিরে আসেন সন্ধ্যায়। বাড়িতে কিছুক্ষণ বসে তারপর ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন আগের মতো ঠিক সকালে আবার চলে যান। আমার কলেজ বন্ধ থাকার সুবাদে বাড়ির পাশে থাকা জমিতে কাকরোল চাষ করেছি আর আব্বুকে সাহায্যের জন্য মাঝেমধ্যে পাহাড়ে যাই। লকডাউনের মধ্যে কোনো রকমে চলছে আমাদের সংসার। বাবা বাবার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন সচেতনতার সঙ্গে। বলতে পারেন এক রকম কোয়ারেন্টিন পালন করছেন পেশাদারত্ব বজায় রেখে।

হ্যাঁ, বাবারা এ রকমই হয়, সংগ্রাম আর রক্তের বিনিময়ে হলেও সন্তানদের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেওয়াই তাঁদের লক্ষ্য। স্যালুট সেই বাবাদের, বেঁচে থাকুক তাঁরা হাজারো বছর।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি আলাওল কলেজ, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম।