চেনা শহরটাকে খুব অচেনা লাগছে

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ–বেদনাভরা গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাস থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
অলংকরণ : প্রথম আলো
অলংকরণ : প্রথম আলো

জরুরি প্রয়োজনে দীর্ঘ দু'সপ্তাহ পর 'কোয়ারেন্টিন' নামক বন্দিদশা থেকে বাইরে বের হয়েছিলাম। বের না হয়ে উপায় ছিল না। ৫ মাস বয়সী মেয়েটার সর্দি-জ্বর-কাশি। ডাক্তারের সিরিয়াল পেয়েছিলাম বিকেল ৩টায়, সুতরাং হাতে সময় নিয়ে ২টায় বেরিয়ে পড়লাম।

আমি জেলা শহরে থাকি। চারদিকে সুনসান নীরবতা। একটা ইজিবাইক রিকশায় আমরা চলেছি। মাথার ওপর প্রখর চওড়া রোদের ৩৬-৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তপ্ত আবহ। এই গরমে রাস্তায় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে হাপিয়ে ওঠার মতো মানুষ নেই, কোথায় যেন পালিয়েছে সব। আশপাশের বাড়িঘরগুলোও নিঃশব্দ-নিস্তব্ধ। বোধহয় সবাই ভীত; আতঙ্কে বাকহীন অবরুদ্ধ, জোরে শ্বাস নিলেই বুক-পাজরে ঢুকে পড়বে কোভিড-১৯।

রাস্তার দু'পাশজুড়ে মেহগনি গাছে নতুন পাতা এসেছে। কোনো গাছের পাতায় ধুলোর আস্তরণ নেই। যেন চারদিকে সবুজের প্রতিধ্বনি, সজীবতার প্রতিশ্রুতি। সবুজ বৃক্ষমালা একমনে একপ্রাণে অক্সিজেন নির্মাণে ব্যস্ত, যেন বিশুদ্ধ বাতাস সরবরাহের অক্লান্ত ঠিকাদার। কিন্তু যারা এই অক্সিজেনের নিয়মিত গ্রাহক সেই মানুষ আজ বড় অসহায়, বড় বিপদগ্রস্থ। যে নাক দিয়ে, গলা দিয়ে বুকভরা শ্বাস নেবে সেই গলা আজ চেপে ধরেছে করোনা, সেই ফুসফুস কুরে কুরে খাওয়া শুরু করেছে ভাইরাস। মানুষ মারার জরুরি অ্যাসাইমেন্টে ভীষণ ব্যস্ত এই ভাইরাস।

এই দুপুরে দোকানপাট সব বন্ধ, শহরে ব্যস্ততা নেই কোথাও। একটা বন্ধ ফুলের দোকানের সামনে ক'টা গাথা শুকনো গাঁদা ঝুলছে, যেন নিজেকে বিক্রি না করতে পারার হতাশায় ঝুলে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। চেনা শহরটাকে খুব অচেনা লাগছে। সেই ভিড়ভাট্টার অশান্ত রাস্তাটাকে এখন মনে হচ্ছে তরমুজের বুকের মতো চওড়া। রাস্তার ময়লাহীন ডাস্টবিনগুলো রোদে শুকিয়ে গেছে, উচ্ছিষ্ট নেই। নিত্য চোখে পড়া ক'টা বেওয়ারিশ গরু যারা এই শহরে ঘুরে ঘুরে খায়, তারা ক্লান্ত। বাজারঘাট অচল থাকলে অযথাই তাদের খাবার খুঁজে হন্যে হওয়া। গরু তো! বুদ্ধি করে পুঁজিবাদের পাঠটাও পড়তে পারেনি, খাবারও জমা করে হোম কোয়ারন্টিনে যেতে পারেনি অথবা নিম্নবিত্তের মতো চাইতে পারেনি নি:শর্ত সাহায্য। ক'টা ক্ষুধার্থের অসহায়ের মতো রাস্তায় শুয়ে হাপাচ্ছে।

কোথাও ট্রাফিক নেই, ট্রাফিক পুলিশও নেই। জলপাইরঙা দু'টো গাড়িতে টহলরত একদল সেনা কর্মকর্তা সঙ্গনিরোধ আইন বাস্তবায়ন করছে। ভয়মাখা চোখে টহল পেরিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম, কি নির্মল বিশুদ্ধ আকাশ! অথচ কি নিষ্ঠুর! জমিনজুড়ে মহামারি, তাতে তার যেন কিচ্ছু যায়-আসে না, নীলাকাশ ঈষৎ বিরক্ত মুখে সাদামেঘের দাত বের করে ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসছে। এ হাসির মানে বুঝতে জ্যোতির্বিদ হওয়া লাগে না...'মরার জমিন দূরে মর, মানুষ নিয়ে মর!' ক্লিনিকের সামনে একটা পাতাহীন সজনে গাছের ডালে ক'টা সজনে ডাটা দুলছে- মনে হচ্ছে পুলিশের লাঠি মানুষকে শাসাচ্ছে, একটু এদিক-সেদিক হলেই পিঠে পড়বে কয়েক ঘা। একটা ক্লান্ত কোকিল বসন্ত ভুলে হতাশ মনে বসে আছে।

ক্লিনিকে মুখোশপরা একদল মানুষ। ভিন্ন বয়স, ভিন্ন বর্ণ, ভিন্ন রোগ, ভিন্ন পোষাক- কিন্তু সবার মুখে অভিন্ন মুখোশ। যেন 'পাপী' সবাই, মুখ দেখানো নিষেধ, কথা বলা নিষেধ, ছুঁয়ে দেওয়া নিষেধ। যেন মানুষে মানুষে বৈরীতা, অনাত্মীয়তা। চেম্বারের ডাক্তার সাহেবকে চেনা যায় না, যদিও তিনি আমার পরিচিত। আপদমস্তক পিপিইতে লেমিনিটিং করা, আস্তে করে বললেন, 'এখন সাবধানে থাকার সময়।' অভয় দিয়ে আরও বললেন- 'দিনে চারবার নেবুলাইজ করাবেন।'

বাসায় ফিরে মুখোশ খুলে, কাপড় বদলিয়ে, কুড়ি সেকেন্ড সাবানজলে হাত কচলিয়ে চিন্তা করলাম, এই অদৃশ্য ভাইরাস সুদৃশ্য মানুষকে কতো নাকানি-চুবানিই না খাওয়াচ্ছে!! অনুবেক্ষণযন্ত্রের যান্ত্রিক চোখেও যাকে ঝাপসা লাগে, সেই কীটানুকীট কি না পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও বুদ্ধিমান প্রাণীকে নিরুপায় বানিয়ে ছাড়ল! এ পৃথিবীতে যারা পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক তাদের অসহায় কান্না দেখে আকাশটা কি অট্টোহাসিই না হাসছে।

মানুষ মরার অঙ্কে এখন ধারাপাতের নামতা আর মিলছে না। অভিজাত হতে হতে মানুষ যেন নিজের জাতটাই হারিয়ে ফেলছে দিনকে দিন। পৃথিবীকে নিপীড়ন করছে দিনকে দিন। ভালোবাসার চালান না বাড়িয়ে দিন দিন অস্ত্রের চালান বাড়িয়েছে এই মানুষ। অসভ্যতার ভিতে গড়েছে অসভ্যতার দেয়াল। এই করোনাকাল যেন মনুষ্যজাতির ওপর অন্যান্য সৃষ্টিজগতের সম্মিলিত ক্ষোভ আর অভিশাপ। অ্যাম্বুলেন্সের হুইসেল যেন ইসরাফিলের বাঁশি। মুখোশপরা মানুষের দৌঁড়ানি দেখে আকাশের ব্যঙ্গাত্মক হাসি যেন ঈশ্বরেই ক্ষোভাতুর হাসি। মানুষ বড় অসহায়। নিষ্ঠুর আসমানের দিকে চেয়ে বেকুবের মতো কান্না ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে অসহায় মানুষের!!

অনিশ্চিত অবসরে এখন মানুষের দিন-তারিখ-সময় সব হারিয়ে গেছে মহাকালের নিষ্ঠুরতায়। দেয়াল ক্যালেন্ডারেরা সব অকেজো নিষ্প্রয়োজন, গুরুত্বহীন। রাতভর দু:স্বপ্নের অন্ধকার রাত আর দিনভর দুশ্চিন্তার উত্তপ্ত দিন। ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে পড়া পৃথিবীতে ছোট হয়ে আসা নি:শ্বাস কেবলই নি:শেষ হওয়ার অপেক্ষা অথবা আরোগ্য লাভের আশায় থুক্কু বলে আবার শুরু...নিরোগ পৃথিবী যেখানে সমস্ত সৃষ্টির সহমর্মীতার বসবাস। উত্তরটা কেবল সময়ই জানে।

*লেখক: পরিচালক, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ইনস্টিটিউট