হালদায় এবার বেশি পোনা মিলবে, কী কারণ জানালেন বিশেষজ্ঞরা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদী থেকে এবার মা মাছের বেশি ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। শিল্পকারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানার বর্জ্যে দূষিত হালদা থেকে প্রত্যাশিত রেণু পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন এগুলো বন্ধ থাকায় আগের তুলনায় বেশি রেণু পাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন নদী পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে মানবজীবন স্থবির হয়ে পড়লেও কমেছে দূষণের মাত্রা। আর এ জন্যই হালদায় মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ বাড়তে পারে।

আশার বিপরীতে শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। সাধারণ ছুটির কারণে সারা দেশে যান চলাচল বন্ধ। আবার হাটহাজারী উপজেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে সংগ্রহ করার পর রেণু বিক্রি এবং পরিবহন করা নিয়ে চিন্তায় আছেন পোনা আহরণকারীরা। তবে ডিম সংগ্রহের জন্য সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন তাঁরা।

তবে হালদা নদীর পোনার ক্রেতাদের আসা-যাওয়াসহ সব ধরনের সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। রেণুর বাজারে যাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকে তাও নিশ্চিত করবে প্রশাসন।

প্রতি বছর বজ্রপাতসহ মৌসুমের প্রথম ভারী বর্ষণের সময় হালদায় ডিম ছাড়ে মা মাছ। মূলত এপ্রিলের শেষ বা মে মাসে বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল নামলে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালাবাউশ জাতীয় মা মাছ ডিম ছাড়ে।

অন্যান্যবারের তুলনায় এবার নদীতে বেশি ডিম পাওয়া যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞ ও রেণু সংগ্রহকারীরা। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, এখন নদী দূষণকারী দুটি প্রতিষ্ঠান (বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পেপারমিল) বন্ধ রয়েছে। লকডাউনের কারণে নদী সংলগ্ন বিভিন্ন কারখানার দূষণও নেই। ড্রেজার চলাচল বন্ধ ও মা মাছের মৃত্যু তুলনামূলক কম হওয়ার বেশি ডিমের আশা দেখছেন।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৫ মে ডিম ছাড়ে হালদার মা মাছ। আহরণ করা প্রায় ১০ হাজার কেজি ডিম থেকে ২০০ কেজির কিছু বেশি রেণু উৎপাদিত হয়েছিল।

২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল হালদায় ডিম ছাড়ে মা মাছ; সংগ্রহ করা হয় ২২ হাজার ৬৮০ কেজি ডিম। উৎপাদিত রেণু ছিল ৩৭৮ কেজি।

হালদা নদী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনজুরুল কিবরীয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক এই অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, হালদা নদী দূষণকারী এশিয়ান পেপার মিল ও হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ ছুটির কারণে অক্সিজেন ও কুলগাঁও এলাকার অনেক কারখানা বন্ধ। এতে নদীর দূষণ অনেক কমেছে। এছাড়া বালুর ড্রেজার চলাচল বন্ধ এবং উজানে তামাক চাষও ৭০ শতাংশ বন্ধ হয়েছে। এ বছর মা মাছ তেমন মারা যায়নি। প্রশাসনেরও নজরদারি ছিল। সব মিলিয়ে গত ২০ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে হালদা। তাই আশা করছেন পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে গতবারের চেয়ে বেশি ডিম পাওয়া যাবে।

ডিম বেশি পাওয়া গেলেও দেশের এই পরিস্থিতিতে তা বিক্রি হওয়া নিয়ে কিছুটা সন্দিহান তিনি। বলেন, এই সময়ে মা মাছ ডিম ছাড়লেও পোনা কিনতে ক্রেতারা কীভাবে আসবে, আসলেও কতজন আসবেন? তবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

পোনা সংগ্রহকারীরা হালদা নদীর নদীর রাউজান ও হাটহাজারী অংশে নদীর আজিমের ঘোনা, অংকুরি ঘোনা, রাম দাশ মুন্সীর ঘাট, সত্তারঘাট, মাছুয়া ঘোনা, মাদার্শা, কাগতিয়া, গড়দুয়ারাসহ বিভিন্ন অংশ থেকে ডিম সংগ্রহ করেন।

হাটহাজারীর গড়দুয়ারা এলাকার ডিম আহরণকারী কামাল উদ্দিন বলেন, এবার নদীতে মা মাছের আনাগোনা অনেক। ভারী বৃষ্টি হলেই ডিম ছাড়তে পারে। তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

তবে কয়েকটি সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর মতে, ডিম সংগ্রহে সহায়তাকারী হিসেবে যারা নৌকায় কাজ করেন তাঁদের অনেকেই আশপাশের গ্রামের। এখন গাড়ি চলাচল বন্ধ। তাঁরা আসবেন কীভাবে। তাঁরা না আসলে ডিম সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে যাবে।

পোনা সংগ্রহকারীরা জানান, রেণু পোনা কিনতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, যশোর, রাজশাহী, বরিশাল, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহসহ অন্তত ১৭ জেলার লোকজন আসে। এবার তাঁরা তো আসতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। তাঁরা আসতে না পারলে পোনা বিক্রি হবে না।

মা মাছের ডিম আহরণের পর রেণু পোনা ফোটাতে হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা, শাহমাদারি ও মাছুয়াঘোনা এবং রাউজান উপজেলার মোবারক খিল ও পশ্চিম গহিরার মোট পাঁচটি সরকারি হ্যাচারির ১৬৭টি কুয়া প্রস্তুত করেছে স্থানীয় প্রশাসন। পাশাপাশি স্থানীয়দের আরও শতাধিক কুয়াও প্রস্তুত করা হয়েছে।

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, পোনার ক্রেতাদের আসা-যাওয়ার ব্যাপারে প্রশাসন থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। কেউ যোগাযোগ করলেই তাঁদের প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হবে। আর রেণু সংগ্রহকারী, ক্রেতা--সবার জন্য হালদা কার্ড করা হয়েছে। এই কার্ড নিয়ে তাঁরা রেণু নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারবেন।

হালদা নদীতে কেউ যাতে মা মাছ মারতে না পারে সে জন্য তদারকি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান ইউএনও।