করোনাকালে 'মধ্যাহ্নভোজ কার্যক্রম'

অবিনাশ বাঙলা ফাউন্ডেশন শুরু করেছে করোনাকালে মধ্যাহ্নভোজ কার্যক্রম। ছবি: লেখক
অবিনাশ বাঙলা ফাউন্ডেশন শুরু করেছে করোনাকালে মধ্যাহ্নভোজ কার্যক্রম। ছবি: লেখক

ধীরে ধীরে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের রেস্টুরেন্টটির সামনের রাস্তায়। পাঁচ-সাত বছরের শিশু থেকে ষাটোর্ধ্ব নারী-পুরুষ জমা হতে থাকেন নিরাপদ দূরত্ব মেনে। সবার হাতে খাবার নেওয়ার পাত্র। একে একে তাঁদের হাতে আসতে থাকে রান্না করা খাবার—ভাত, ডাল, আলু দিয়ে রান্না করা মুরগির মাংস। একে একে খাবার নিয়ে যে যাঁর মতো ফিরে যান। এরপরও কিছু মানুষ থেকে যান খাবার পাওয়ার আশায়। নিরুপায় আয়োজক কর্তৃপক্ষের চোখেমুখে বিব্রতকর অবস্থার চিহ্ন ফুটে ওঠে। কাউকে ফেরাতে না চাইলেও ফেরাতে হয় সীমিত ক্ষমতার কারণে।

খাবার নেওয়ার অপেক্ষায় থাকা ষাটোর্ধ্ব সনকা বেগম জানান, তিনি পেটের ব্যারামে অসুস্থ। আগে ভিক্ষা করতেন, কিন্তু গত মাসখানেক ভিক্ষা করা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে খাবার সংগ্রহের লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে তাঁকে। রাশেদা তাজমহল রোডের ফুটপাতে চায়ের দোকান দিতেন। গত এক মাস তাঁর চায়ের দোকান বন্ধ। এই পুরো সময় তিনি পরিবারের সব সদস্যের খাবার পেয়েছেন এখান থেকে। শুধু সনকা বেগম কিংবা রাশেদাই নয়, অবিনাশ বাঙলা ফাউন্ডেশনের এ কার্যক্রমের সুবিধা পাচ্ছেন তাজমহল রোড এবং তাঁর আশপাশের উপার্জনহীন হয়ে পড়া বিভিন্ন পেশার বেশ কিছু মানুষ।

নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা জেনেই করোনাকালের কর্মহীন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠান। তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান অবিনাশ বাঙলা ফাউন্ডেশন, আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই যারা শুরু করতে বাধ্য হয়েছিল মানুষকে এক বেলা হলেও খাবার দেওয়ার কাজ। করোনাকালে লকডাউনের জন্য কর্ম ও উপার্জনহীন হয়ে পড়া তাজমহল রোডের আশপাশের ৩৫টি পরিবারের ১২০ জন মানুষের তালিকা তৈরি করে খাবার বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রাথমিকভাবে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১০০ জন মানুষকে নিয়ে। ইতিমধ্যে ২০ জন মানুষ বেড়েছে। ভবিষ্যতে মানুষের সংখ্যা যে আরও বাড়বে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

তাজমহল রোডের একটি রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপনায় রান্না হচ্ছে রেস্টুরেন্টের রসুইঘরে। ছবি: লেখক
তাজমহল রোডের একটি রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপনায় রান্না হচ্ছে রেস্টুরেন্টের রসুইঘরে। ছবি: লেখক

অবিনাশ বাঙলা ফাউন্ডেশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী সাদাফ হাসনাইন মঞ্জুর জানালেন, প্রাথমিকভাবে পরিচিত বন্ধুবান্ধব এবং নিজের পরিবারের মানুষদের আর্থিক সহায়তায় শুরু হয়েছিল কর্মহীন মানুষদের খাবার বিতরণের এ কাজটি। ক্রমেই তাঁদের আবেদনে সাড়া দিয়ে অর্থনৈতিক সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন দেশ-বিদেশের অনেকে এবং ভবিষ্যতে আরও আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বিভিন্ন মানুষ। ফলে করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে এই কার্যক্রমটির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

এ কার্যক্রমের মূল বৈশিষ্ট্য, শুকনো খাবার না দিয়ে এখানে প্রতিদিন রান্না করা খাবার দেওয়া হয়। শুধু ক্ষুধানিবৃতির জন্যই নয়, সঙ্গে সামান্য হলেও খাবারের পুষ্টিমান যাতে ঠিক থাকে, সে জন্য সপ্তাহের সাত দিন রয়েছে খাবারের নির্দিষ্ট রুটিন। সপ্তাহের একেক দিন ভাতের সঙ্গে দেওয়া হয় মাছ, মুরগির মাংস, ডিম এবং গরুর মাংস। সঙ্গে থাকে ডাল। খাবার বিতরণেও রয়েছে বৈচিত্র্য। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কিছু বেশি ভাত, ডাল ও তরকারির ঝোল দেওয়া হয়, যাতে চাইলে পরিবারের লোকজন রাতেও খেতে পারেন। অথবা নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে দু–একজন বেশি মানুষও ভাগ করে খাবার খেতে পারেন।

খাবার নেওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ মানুষ। ছবি: লেখক
খাবার নেওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ মানুষ। ছবি: লেখক

সাদাফ হাসনাইন মঞ্জুর জানান, তাঁর মালিকানায় থাকা রেস্টুরেন্টটি এখন বন্ধ। যেহেতু নিজের রেস্টুরেন্টে রান্নার সুবিধা আছে, তাই সেখানে রান্না হচ্ছে প্রতিদিন। ছুটিতে থাকা কয়েকজন কর্মচারীকে ডেকে এনে বাজার করা, রান্না ও পরিবেশনের কাজে লাগিয়েছেন তিনি। খাবার দেওয়ার আগে প্রতিটি পাত্রে জীবাণনাশক ছিটানো, কর্মচারীদের গ্লাভস ও মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

মুখে মাস্ক লাগিয়ে খাবারের পাত্র হাতে অপেক্ষা করছিলেন আবদুল কাদের। তিনি এ অঞ্চলেই চটপটির দোকান করতেন। গত মাসের ২৫ তারিখ থেকে তাঁর ব্যবসা বন্ধ, হাতে টাকাপয়সা নেই। পরিবার নিয়ে পড়েছেন সংকটে। এখন বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হচ্ছে অবিনাশ বাঙলা ফাউন্ডেশনের দেওয়া খাবারের ওপর। সাদাফ হাসনাইন মঞ্জুর জানান, এ কার্যক্রমটি শুরু করাই হয়েছে তাঁদের জন্য, যারা একসময় উপার্জনক্ষম ছিলেন এবং যাঁরা গণত্রাণ কার্যক্রমে যেতে চান না। এ জন্য এ কার্যক্রমের আওতায় থাকা মানুষদের সামাজিক মর্যাদা এবং মূল্যবোধের দিকটিও বিবেচনা করা হয় গুরুত্বের সঙ্গে। অবিনাশ বাঙলা ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা এম নুরুল ইসলাম শাহেদ জানান, যেভাবে কিছু মানুষ তাঁদের আর্থিক সহায়তা করছেন, তাতে দীর্ঘ মেয়াদেও এই কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলেই তিনি বিশ্বাস করেন।