'হাওরে কাটলে ধান, মিলবে ত্রাণ'

'হাওরে কাটলে ধান, মিলবে ত্রাণ'—এই হচ্ছে স্লোগান। সুনামগঞ্জের হাওরে এখন বোরো ধান কাটার মৌসুম চলছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি, ধান কাটার শ্রমিক সংকট এবং আগাম বন্যার সতর্কবার্তায় বিপাকে কৃষক। কৃষকদের দ্রুত ধান কাটতে নানাভাবে উৎসাহ, সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। অন্য জেলা থেকে আনা হচ্ছে শ্রমিক। করোনাভাইরাসের কারণে বেকার হয়ে পড়া নানা পেশার শ্রমজীবীদের ধান কাটায় যুক্ত করা হচ্ছে। জেলার জামালগঞ্জ উপজেলায় গতকাল মঙ্গলবার থেকে এ কর্মসূচি শুরু হয়েছে।

উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় যারা ধান কাটলে ত্রাণ পাওয়ার যোগ্য তাদের নিয়ে দল গঠন করেছে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি)। ইউপি কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানেই হাওরে ধান কাটছেন এই দলের সদস্যরা। জেলার প্রতিটি উপজেলায় হাওরে ত্রাণের বিনিময়ে ধান কাটার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ত্রাণ হিসেবে চাল ও নগদ টাকা দেওয়া হবে শ্রমিকদের।

জামালগঞ্জ উপজেলার গজারিয়া বাজারে আমির হোসেনের (২৮) একটি ছোট দোকান আছে। এই দোকানের আয়েই চলে সংসার। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে গত ২০ দিন ধরে দোকান বন্ধ। তাই বেকার তিনি। তাঁর মতো বাজারের আরও অনেক দোকানি বেকার। এ অবস্থায় প্রশাসনের ডাকে তাঁরা হাওরে ধান কাটতে একটি দল গঠন করেছেন। স্থানীয় ইউপির তত্ত্বাবধানে তাঁরা গতকাল দিনভর উপজেলার পাগনার হাওরে পাঁচজন কৃষকের জমির ধান কেটে দিয়েছেন। এতে কৃষকেরা যেমন উপকৃত হচ্ছেন, তেমনি প্রশাসন থেকে তাঁরা পাচ্ছেন ত্রাণ সহায়তা। এতে কৃষকদের কোনো খরচ নেই।

আমির হাসান বললেন, তাদের দলে ৪২ জন সদস্য আছেন। দলে ব্যবসায়ী, ইজিবাইক চালক ও মোটরসাইকেল চালক, বালুশ্রমিক, বেকার, সেলুনের শ্রমিকসহ নানা পেশার লোক আছেন। যেহেতু এখন সব বন্ধ, কোনো কাজ নেই; তাই তাঁরা ধান কাটায় নেমেছেন।
গজারিয়া বাজারে ডেকোরেটরের ব্যবসা করেন আরমান হোসেন (৪০)। তিনিও আছেন এই দলে। আরমান বলেন, 'আমরা তো কৃষক পরিবারেরই সন্তান। সব কাজই পারি। কিন্তু অন্য সময় হলে হয়তো করতাম না। এখন নিজেরা বেকার, অন্যদিকে কৃষকেরাও সংকটে। তাই ধান কাটায় যুক্ত হয়েছি।'

আমির হাসান ও আরমান হোসেন জানালেন, জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রিয়াংকা পাল এভাবে দল গঠন করে ধান কাটায় যুক্ত হতে তাদের উৎসাহ দিয়েছেন। ধান কেটে দেওয়ার জন্য কৃষকের কাছ থেকে তাঁরা কোনো টাকা নেননি। ইউনিয়ন পরিষদের তদারকিতে তাঁরা কাজটি করেছেন। আগামী ১৫দিন তাঁরা হাওরে ধান কাটবেন।

গজারিয়া গ্রামের কৃষক আরিফুল হক বলেন, 'জমির ধান পাকা অবস্থায় ছিল। কিন্তু শ্রমিক নেই। হাতে কোনো টাকা–পয়সাও নেই। তাই ধান কাটতে পারছিলাম না। এখন ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে জমির ধান কেটে দেওয়ায় অনেক উপকার হয়েছে। আমার মতো অনেক গরিব কৃষক জমির ধান নিয়ে বেকায়দায় আছেন। তাদেরও সহযোগিতা করা উচিত।'

ফেনারবাক ইউপির সচিব অজিত কুমার রায় বলেন, তিনি নিজে ধান কাটা দলের সঙ্গে সার্বক্ষণিক ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার এই দল পাঁচজন কৃষকের ১২ কিয়ার (৩০ শতকে এক কিয়ার) জমির ধান কেটে দিয়েছেন। উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রতি কিয়ারের জন্য ৫০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। আর ইউপি চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু তালুকদার প্রতি কিয়ারের জন্য তাদের ৫০০ টাকা করে উপহার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রতিদিন দলটি হাওরে ধান কাটবেন।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, 'কাটলে ধান, মিলবে ত্রাণ'—এই স্লোগনে জেলার প্রতিটি উপজেলায় ইউনিয়ন পরিষদের তত্ত্বাবধানে দল গঠন করে ধান কাটায় মানুষদের যুক্ত করার নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য পেশার লোকজনকে ধান কাটায় যুক্ত করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জেলার বিশ্বম্ভরপুরের ইউএনও সমীর বিশ্বাস বলেন, এই উপজেলার বালু মহাল বন্ধ করে শ্রমিকদের ধান কাটায় লাগানো হয়েছে। একইভাবে হাওরে নামানো হয়েছে মোটরসাইকেল, অটো ও ইজিবাইক চালকদেরও।

ছাতক উপজেলার ইউএনও মো. গোলাম কবির বলেন, 'আমরা এমনিতেই করোনা পরিস্থিতিতে প্রতিটি ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করেছি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁরাও কাজ করছেন। পাশাপাশি তাঁরা কৃষকদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।'

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ বলেন, 'এই মুহুর্তে হাওরে ধান কাটার বিষয়টি আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। বলা যায় প্রশাসন, কৃষি বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা মাঠে আছেন। সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমান গত দুই দিন ধরে সুনামগঞ্জের হাওরে ঘুরে বিষয়টি তদারকি করছেন। ২৫ এপ্রিল থেকে ব্যাপক বৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে আমরা চিন্তিত। তাই দ্রুত হাওরের ধান কাটতে নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে।'

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের হাওরে এবার বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ লাখ মেট্রিক টন। হাওরে পুরো ধান কাটতে আরও ১৫ থেকে ২০দিন সময় লাগবে।