করোনার সংক্রমণ ছড়িয়েছে ৫৮ জেলায়

সূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
সূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগে কয়েক দিন ধরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। এখনো রোগীর সংখ্যা শতক না পেরোলেও রংপুর আর বরিশাল বিভাগেও সংক্রমণ বাড়ার প্রবণতা আছে। বিপরীতে এখন পর্যন্ত সিলেট, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে সংক্রমণ কম।

শুরু থেকেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। এখনো রোগীদের ৮৪ শতাংশই ঢাকা বিভাগে।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করার ঘোষণা দেয় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের ৪৬তম দিন গতকাল বুধবার পর্যন্ত ৬৪টি জেলার ৫৮টিতেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ১১টিতে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল। অর্থাৎ গত ১৭ দিনের মধ্যে নতুন করে ৪৭টি জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে তিনটি জেলায় সংক্রমণ পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো কুষ্টিয়া, মাগুরা ও মেহেরপুর।

>দেশে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত সংক্রমণমুক্ত জেলা ছয়টি—খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, ভোলা, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা ও নাটোর।

এখন পর্যন্ত যে ছয়টি জেলায় সংক্রমণ ধরা পড়েনি, তার দুটি পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি। একটি দ্বীপ জেলা ভোলা। দুটি খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরা; আর অন্যটি রাজশাহী বিভাগের নাটোর।

 গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট ৩ হাজার ৭৭২ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তবে আইইডিসিআর রোগীদের জেলা ও বিভাগওয়ারি যে হিসাব তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে, তাতে ৫৮টি জেলার মোট ২ হাজার ৯৮৩ জন রোগীর তথ্য আছে। এই সংখ্যার ভিত্তিতেই ৮ বিভাগে রোগীর শতাংশের হার হিসাব করা হয়েছে।

রোগীদের সিংহভাগ ঢাকা বিভাগের। তাঁদের মধ্যে এক হাজারের বেশি বা মোট রোগীর ৪১ শতাংশ ঢাকা মহানগরীর। এরপর জেলা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি রোগী ঢাকা বিভাগের নারায়ণগঞ্জে (৫০৮ জন)। গাজীপুর (২৬৯ জন), নরসিংদী (১৩৬ জন) ও কিশোরগঞ্জ (১৪৬ জন) জেলায়ও রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। এই জেলাগুলো একটি অন্যটির সীমান্তবর্তী। ঢাকা মহানগর বাদে ঢাকা বিভাগে আছে মোট আক্রান্তের ৪২ দশমিক ৯২ শতাংশ।

চট্টগ্রামে রোগী বাড়ছে

৫ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার মধ্যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও কুমিল্লা—এই তিনটিতে ৩ জন আক্রান্ত ছিলেন। ১২ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৬টি জেলায় আক্রান্ত ছিলেন মোট ৩৫ জন। এর ১০ দিনের মাথায় গতকাল পর্যন্ত এই বিভাগের ৯টি জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪২। সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম জেলায়, ৪২ জন। এরপর লক্ষ্মীপুরে ২৫ ও কুমিল্লায় ২৫ জন। এই বিভাগে গত ২৪ ঘণ্টায় রোগী বেড়েছে ১৭ জন। তাঁদের মধ্যে ১৩ জনই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার। সম্প্রতি এই জেলায় একটি জানাজায় হাজার হাজার মানুষের জমায়েত হয়েছিল।

চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবানে চারজনের মধ্যে সংক্রমণ পাওয়া গেলেও এখন পর্যন্ত রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে কোনো রোগী পাওয়া যায়নি।

বিভাগওয়ারি হিসেবে ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি রোগী চট্টগ্রামে। আক্রান্তদের ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ এই বিভাগের।

সংক্রমণ বাড়ছে ময়মনসিংহে

ঢাকা বিভাগের নিকটবর্তী ময়মনসিংহ বিভাগে দ্রুত ছড়াচ্ছে সংক্রমণ। বিভাগওয়ারি হিসাবে আক্রান্তদের দিক থেকে তৃতীয় শীর্ষস্থানে আছে ময়মনসিংহ। মোট আক্রান্ত রোগীর ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ এই বিভাগের।

এই বিভাগের চারটি জেলাতেই সংক্রমণ আছে। ১২ এপ্রিল পর্যন্ত এখানকার চারটি জেলা মিলিয়ে মোট রোগী ছিলেন ১৪ জন। তাঁদের মধ্যে জামালপুরে ৬, ময়মনসিংহে ৫, শেরপুরে ২ ও নেত্রকোনায় ১ জন। এখানকার চারটি জেলাতেই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এখন এই বিভাগে মোট রোগীর ১৩২ জন। তাঁদের মধ্যে ময়মনসিংহ জেলায় ৬২ জন, জামালপুরে ২৯ জন, নেত্রকোনায় ২২ জন ও শেরপুরে ১৯ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এসব জেলায় মূলত সংক্রমণ ছড়িয়েছে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা থেকে যাওয়া ব্যক্তিদের মাধ্যমে।

সংক্রমণ কম খুলনা, সিলেট, রাজশাহীতে

দেশের যে ছয়টি জেলায় এখন পর্যন্ত সংক্রমণ পাওয়া যায়নি, তার তিনটি খুলনা বিভাগে। এই বিভাগে জেলা ১০টি। ১২ এপ্রিল পর্যন্ত শুধু চুয়াডাঙ্গায় একজন আক্রান্ত ছিলেন। এখন পর্যন্ত এই বিভাগের সাতটি জেলায় সংক্রমণ পাওয়া গেছে। যার তিনটিতে সংক্রমণ ধরা পড়েছে গত ২৪ ঘণ্টায়। তবে এই বিভাগে রোগী খুব একটা বাড়ছে না। গতকাল পর্যন্ত এখানকার আটটি জেলায় শনাক্ত হয়েছেন ২৪ জন। মোট আক্রান্তদের শূন্য দশমিক ৭১ শতাংশ খুলনায়।

সিলেট বিভাগের চারটি জেলাতেই সংক্রমণ পাওয়া গেছে। ১২ এপ্রিল পর্যন্ত সিলেট বিভাগে মোট চারজন শনাক্ত ছিলেন। গতকাল পর্যন্ত সেটা ২০ জনে সীমাবদ্ধ ছিল। মোট রোগীর শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ সিলেটের।

দেশের আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে পরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চিহ্নিত হয় রাজশাহী বিভাগে। ১৩ এপ্রিল সেখানে সংক্রমণ পাওয়ার খবর জানায় আইইডিসিআর। ওই দিন পর্যন্ত সেখানে মাত্র একজন আক্রান্ত শনাক্ত ছিলেন। গতকাল পর্যন্ত এই বিভাগের ৮টি জেলার সাতটিতে মোট রোগী শনাক্ত হয়েছেন ২৫ জন। মোট আক্রান্ত রোগীর শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ এই বিভাগের।

বরিশাল, রংপুরেও বাড়ছে

দ্বীপ জেলা ভোলা ছাড়া বরিশালের বাকি পাঁচটি জেলাতেই রোগী শনাক্ত হয়েছে। ১২ এপ্রিল পর্যন্ত এখানকার তিন জেলায়—বরগুনা, ঝালকাঠি ও পটুয়াখালীতে ৭ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। এরপর গতকাল পর্যন্ত ওই তিন জেলা এবং বরিশাল ও পিরোজপুর মিলে পাঁচ জেলায় মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭০। মোট শনাক্তের ২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বরিশাল বিভাগের।

রংপুর বিভাগেও রোগী বাড়ছে। ১২ এপ্রিল পর্যন্ত এখানকার ৮টি জেলার ৫টিতে মোট ১৫ জন রোগী শনাক্ত ছিলেন। এখন এ বিভাগের সব জেলাতেই সংক্রমণ পাওয়া গেছে। গতকাল পর্যন্ত এই বিভাগের ৮ জেলায় মোট রোগী ছিলেন ৬০ জন। দেশের মোট আক্রান্ত রোগীর ১ দশমিক ৭৭ শতাংশ রংপুর বিভাগের।

সংক্রমণ ঠেকাতে জেলায় জেলায় লকডাউন (অবরুদ্ধ) ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বলছেন, এই লকডাউন আশানুরূপভাবে কার্যকর হচ্ছে না। আক্রান্ত এলাকাগুলো থেকে মানুষজন লকডাউন ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছেন। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে লকডাউন কার্যকর করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা জরুরি।

তবে আইইডিসিআরের পরামর্শক ও রোগতত্ত্ববিদ ডা. মুশতাক হোসেন মনে করেন, শুধু ঘরে থাকা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান এবং লকডাউন দিয়ে সংক্রমণ ছড়ানো ঠেকানো যাবে না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভাইরাস সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে র‍্যাপিড রেসপন্স টিম গঠন করতে হবে। ঘরে ঘরে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে রোগী খুঁজে বের করতে হবে। তাঁদের আলাদা করে চিকিৎসা দিতে হবে। প্রতিটি সংক্রমণের উৎস খুঁজে বের করতে হবে। প্রতিটি এলাকা নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। অনেক মানুষ বিশেষত নিম্ন আয়ের মানুষ কেন লকডাউন মানছে না, তার যৌক্তিক কারণ আছে। সে বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।