বকেয়া ২০ কোটি টাকা পেতে চিনিকলে ঘুরছেন আখচাষিরা

আখ খেত। ফাইল ছবি
আখ খেত। ফাইল ছবি

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের কৃষক বদিউজ্জামান টিটন। উৎপাদিত ফসল বিক্রি করেই তাঁর সংসার চলে। আখ বিক্রির পাওনা ২ লাখ টাকার জন্য দিনের পর দিন ঘুরছেন মোবারকগঞ্জ চিনিকলে। কিন্তু কোনো টাকা পাননি। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এখন সব কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চরম অর্থকষ্টে ভুগছেন তিনি।

শুধু বদিউজ্জামান নন, কালীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত মোবারকগঞ্জ চিনিকলের কাছে ছয় হাজারের বেশি চাষির প্রায় ২০ কোটি টাকা পাওনা আছে। এর সবই আখ বিক্রির। গত ডিসেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চাষিরা চিনিকলে এই আখ বিক্রি করেছেন। এখনো তাদের সেই টাকা পরিশোধ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

এই আখ থেকে চিনি তৈরির কাজে যে ৯০০ শ্রমিক-কর্মচারি নিয়োজিত, তাঁরাও গত তিন মাস বেতন পাননি। চিনিকলের কাছে তাদের পাওনা রয়েছে ৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এই টাকা না পেয়ে শ্রমিক-কর্মচারীদের পরিবারে হাহাকার শুরু হয়েছে। ১৯ এপ্রিল মোবারকগঞ্জ চিনিকল শ্রমিক ও কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়নের সভাপতি গোলাম রসুল এই তথ্য জানিয়েছেন।

চিনিকলের একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে চিনিকলের আওতাধীন ৬ হাজারের বেশি আখচাষি আছেন। সদ্য শেষ করা আখ মাড়াই মৌসুমে চিনিকল কর্তৃপক্ষ চাষিদের কাছ থেকে ১ লাখ ৩৯ হাজার মেট্রিক টন আখ কেনে। এই আখের মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর থেকে আখ কেনা শুরু হয়। শেষ হয়েছে ৭ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্যে ৩০ কোটি টাকা চাষিদের পরিশোধ করা হয়েছে। এখনো চাষিদের ১৯ কোটি ২২ লাখ টাকা পাওনা আছে।

কৃষকদের অভিযোগ, কঠোর পরিশ্রম করে তাঁরা জমিতে ফসল (আখ) ফলিয়ে থাকেন। সেই ফসল চিনিকলে বিক্রি করেন। কিন্তু তাদের সময় মতো টাকা দেওয়া হয় না। মাসের পর মাস টাকার জন্য ঘুরে তাঁরা আখ চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। অনেক চাষি আগামীতে আর আখ চাষ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

জেলার শৈলকূপা উপজেলার কৃষক জয়নাল আবেদিন বলেন, তাঁরা টাকার জন্য ফসল চাষ করেন। চিনিকলের কর্মকর্তাদের অনুরোধে লাভজনক ফসল রেখে আখ চাষ করেন। কিন্তু আখ বিক্রির পর টাকা পরিশোধ নিয়ে টালবাহানা শুরু হয়। দিনের পর দিন ঘুরতে হয় চিনিকলে। তিনি বলেন, অধিকাংশ চাষি শ্রমিক দিয়ে খেত থেকে আখ কাটিয়ে থাকেন। এই আখ পরিষ্কার করে পরিবহনে করে ক্রয় কেন্দ্রে নিতে হয়। এতে প্রচুর টাকা খরচ হয়। আশা থাকে আখ বিক্রির টাকা পেলে খরচের টাকা পরিশোধ করবেন। কিন্তু চিনিকল কর্তৃপক্ষ সময়মতো আখের টাকা না দেওয়ায় তাঁরা সমস্যায় পড়ে যান। যারা তাদের কাছে টাকা পাবেন, তাঁরা প্রায়ই নানা কথা শুনিয়ে দেন।

কালীগঞ্জ উপজেলার মনোহরপুর গ্রামের চাষি বদিউজ্জামান বলেন, তিনি টাকার জন্য ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। গত বছর ৯ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছিলেন। এবারও ১০ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন। এখন বুঝতে পারছেন, এটা ভুল হয়েছে। তাঁর খেতে যে শ্রমিকেরা কাজ করেছেন, তাঁরা এখনো ৩২ হাজার টাকা পাবেন। তিনি চিনিকলের কাছে ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা পাবেন। এই টাকা পেলে তাঁর কোনো কষ্ট থাকতো না।

আরেক কৃষক আবদুল কাদেরের পাওনা ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। তিনিও চিনিকলে ঘুরছেন টাকার জন্য। টাকা না পেলে কীভাবে চলবেন এই ভেবে সারাক্ষণ পথে পথে ঘুরছেন। চিনিকলের বড় চাষী শাহজাহান আলী শেখের পাওনা আছে ৪ লাখ টাকা।

মোবারকগঞ্জ চিনিকল আখ চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাছুদুর রহমান বেলন, দেশের এই পরিস্থিতিতে আখ চাষিরা কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। অথচ তাদের উৎপাদিত ফসল আখ বিক্রির অনেক টাকা পাওনা রয়েছে। যে টাকা পেলে তাদের এই কষ্ট দূর হবে। সরকার নানা ক্ষেত্রে প্রণোদনা দিচ্ছে। তিনি আখ চাষিদের পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

জানতে চাইলে মোবারকগঞ্জ চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক আনোয়ার কবির বলেন, আগামী শুক্রবার তাঁরা প্রায় ৩৫ লাখ টাকা কৃষকদের দেবেন বলে আশা করছেন। এই টাকা চিনি বিক্রি থেকে তাঁরা উপার্জন করেছেন। বর্তমানে চিনিকলের গুদামে প্রায় ৩০ কোটি টাকা মূল্যের ৪ হাজার ৯ শত মেট্রিক টন চিনি বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছে। এই চিনি বিক্রি হলে চাষি ও শ্রমিক–কর্মচারীদের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব। বিক্রি না হওয়ায় এই বকেয়া বলে জানান তিনি।