বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষ দ্বিগুণ বাড়তে পারে

বিশ্বে তীব্র খাদ্যসংকট বা অনাহারের সঙ্গে অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা প্রকটতর হবে। ছবি: আনিস মাহমুদ
বিশ্বে তীব্র খাদ্যসংকট বা অনাহারের সঙ্গে অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা প্রকটতর হবে। ছবি: আনিস মাহমুদ

আধপেটা খেতে পায়, ক্ষুধা পেটে রাতে ঘুমাতে যায় —গত বছর বিশ্বে এমন মানুষের সংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ৫০ লাখ। কোভিড-১৯–এর জেরে চলতি বছরের শেষ নাগাদ সংখ্যাটা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে।

তীব্র খাদ্যসংকটে বা তার চেয়েও খারাপ অবস্থায় থাকা মানুষদের গত বছরের খতিয়ান পাওয়া যাচ্ছে ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস–২০২০’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে। এই মানুষেরা বিশ্বের ৫৫টি দেশের বাসিন্দা। দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও আছে।

বিশ্বে তীব্র ক্ষুধার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিসহ (ডব্লিউএফপি) মোট ১৬টি সংস্থা ২০ এপ্রিল এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কোভিড-১৯ দুর্যোগের আগেই প্রতিবেদনের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল।

তবে প্রতিবেদনে শঙ্কা জানানো হয়েছে, করোনাভাইরাসের বিশ্বজোড়া সংকটের প্রভাব খাদ্য ও ক্ষুধার ওপরেও পড়বে। আর তীব্র খাদ্যসংকট বা অনাহারের সঙ্গে অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা প্রকটতর হবে।

এদিকে ১৬ এপ্রিল ডব্লিউএফপির বার্তা প্রকাশের ওয়েবসাইট ইনসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে সংস্থাটির সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেটা বলছে, আশু ব্যবস্থা না নিলে কোভিড–১৯–এর কারণে চলতি বছরের শেষ নাগাদ বিশ্বে তীব্র ক্ষুধা বা তার চেয়েও খারাপ সংকটে থাকবে ২৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় ক্ষুধা-বিপন্ন মানুষের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

ওই নিবন্ধে ডব্লিউএফপির প্রধান অর্থনীতিবিদ আরিফ হোসেনকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, নতুন এই হিসাব থেকে সামনের বিপর্যয়ের একটা ধারণা পাওয়া যায়। অনাহারের ঝুঁকিতে থাকা লাখ লাখ মানুষ করোনাভাইরাস অথবা এর অর্থনৈতিক পরিণতির শিকার হতে পারে।

এই অর্থনৈতিক ঝুঁকির নাম কাজ ও উপার্জন হারানো। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইতিমধ্যেই কমেছে। ওই সাক্ষাৎকারে আরিফ আরও বলেছেন, সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে বাণিজ্য এবং দেশে দেশে পণ্য চলাচল বন্ধ হলে বিপত্তি বাড়বে। খাদ্যনিরাপত্তা বিরাট ঝুঁকিতে পড়বে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, বড় দুর্যোগের সময় খাদ্যসংকট হওয়া স্বাভাবিক। তবে সর্বোচ্চ সক্ষমতা নিয়ে বন্যা আসার আগে হাওরের ধান কাটার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রধান খাবার চালের এবার উৎপাদন বেশ ভালো হয়েছে। মজুতও যথেষ্ট পরিমাণে আছে। সরকার বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে গরিব মানুষদের চাল দেওয়ার কাজ অব্যাহত রেখেছে। প্রয়োজনে তা বাড়ানো হবে।

গত বছরে ক্ষুধার চিত্র

বিশ্ব খাদ্যসংকটের প্রতিবেদনটি এই ধারার চতুর্থ প্রতিবেদন। সেটা বলছে, এমনিতেই ২০১৯ সালে আগের তিন বছরের চেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষ অনেক বেশি ছিল। দেশ ও অঞ্চলও বেড়েছিল।

গত বছর তীব্র ক্ষুধার পেছনে মূল কারণ ছিল যুদ্ধ-সংঘাত। বড় কারণ ছিল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর অর্থনৈতিক সংকট। শরণার্থী বা উদ্বাস্তু থাকা দেশগুলোতে খাদ্যসংকটে ভোগা মানুষ বেশি ছিল।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ক্ষুধা পরিস্থিতি দেখতে গিয়ে কক্সবাজারের পরিস্থিতি আলাদা করে দেখা হয়েছে। বলা হয়েছে, সে জেলায় মোট ১৩ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য ও পুষ্টিসংকটে ভুগছে। তাদের দুই-তৃতীয়াংশই রোহিঙ্গা শরণার্থী।

বাদবাকি প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সদস্য। শরণার্থীদের চাপে তাদের কর্মসংস্থান কমেছে, সম্পদ কমেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হওয়ায় নদীতে মাছ ধরার মতো জীবিকাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তীব্র খাদ্যসংকটের আরেক নাম পুষ্টিহীনতা। তীব্র ক্ষুধাপীড়িত ৫৫টি দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৭ লাখ শিশু শীর্ণ বা কৃষকায়। অপুষ্টির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে এই বয়সী শিশুদের মধ্যে খর্বকায় হওয়ার হার। বিশ্বে সাড়ে সাত লাখ শিশু এমন।

বাংলাদেশে এই বয়সী শিশুদের এক-তৃতীয়াংশ খর্বকায়। এটা বাংলাদেশের সার্বিক পুষ্টি পরিস্থিতির একটা ধারণা দেয়।

এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে এদিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ৪১ শতাংশ অনূর্ধ্ব-৫ বছর বয়সী খর্বকায় শিশু নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আফগানিস্তান। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ইয়েমেন ও পাকিস্তানের (৪৭ শতাংশ)।

বাংলাদেশের মাত্র ৭ শতাংশ এই বয়সী শিশু বেড়ে ওঠা এবং সব রকম বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় যথেষ্ট বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার পায়। শিশুর পুষ্টির সঙ্গে খাদ্যশক্তি, সুপেয় পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসেবারও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

বাংলাদেশ পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাল ছাড়াও আমাদের অন্য যেসব খাদ্য আছে, সেগুলোর দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। বিশ্ব খাদ্য মন্দা ও সংকট শুরু হলে তার প্রভাব দেশে যাতে না পড়ে, সে জন্য সরকারকে এখনই জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য কৃষি খাতে প্রণোদনা দেওয়া দরকার, সরকার সেটা দিচ্ছে। তবে তা যাতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা পায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, বড় বিপদে এসব উদ্যোক্তা আমাদের সবচেয়ে বড় সহায় হবে।’