ভুট্টার ফলন ভালো, ন্যায্যমূল্য আসবে তো

ভুট্টার ফলন ভালো হলেও করোনায় ন্যায্যমূল্য পাওয়ার চিন্তায় কৃষক। ছবি: প্রথম আলো
ভুট্টার ফলন ভালো হলেও করোনায় ন্যায্যমূল্য পাওয়ার চিন্তায় কৃষক। ছবি: প্রথম আলো

লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তার ধু ধু চরগুলোর চিত্র এখন পাল্টে গেছে। বালুজমি আগে ফাঁকা পড়ে থাকলেও এখন চারদিকে সবুজ ভুট্টাখেত। তিস্তাপারের এলাকায় দুর্গম এই ধু ধু বালুচরে কৃষকের এখন একমাত্র লাভজন ফসল ভুট্টা। এই ভুট্টা বদলে দিয়েছে তাঁদের জীবনমান। অথচ কয়েক বছর আগেও এখানকার মানুষ এসব জমিতে তামাকের চাষ করত।

কৃষকেরা বলছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারে ফলন বেশ ভালো। তবে তাঁদের দাবি, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত তাঁরা। ভালো ফলনের পরও দাম পাবেন কি না, তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। বিভিন্ন সময় মাঠে ফসলের লোকসানের পর ভুট্টা চাষে কিছু লাভের স্বপ্ন ছিল কৃষকের মনে। সেই ভুট্টাতেও তাঁরা সঠিক দাম পাচ্ছেন না। বাজার ব্যবস্থাপনা ও ন্যায্যমূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা না থাকায় কৃষক পাচ্ছেন না ফসলের দাম। এবার যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাস। এতে দাম আরও কমে যাবে বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেক কৃষক।

হাতীবান্ধা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ জানান, ধান চাষ দিন দিন কমে যাচ্ছে। অন্যদিক ভুট্টা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন কৃষক। এ উপজেলায় ২৩ হাজার ৫২৯ হেক্টর চাষযোগ্য আবাদি জমি রয়েছে। এর মধ্যে চর অঞ্চল রয়েছে ২ হাজার ২৪৩ হেক্টর। চলতি বছরে ১২ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর ১২ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়। তার আগের বছর চাষ হয়েছিল ১০ হাজার হেক্টর জমিতে।

হারুন অর রশিদ বলেন, এ অঞ্চলের মাটি বেলে–দোঁয়াশ মাটি। তাই বোরো ধান চাষে সেচের পানিতে বেশি খরচ লাগে। ফলে কৃষকদের ধান চাষের আগ্রহ কমে গেছে। অন্যদিকে ভুট্টা চাষে সেচ খরচ কম, উত্পাদন বেশি। তাই কৃষকেরা ভুট্টা চাষের দিকে বেশি ঝুঁকছেন।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ভুট্টা চাষ করে ভালো ফলন পেলেও আশানুরূপ লাভের মুখ দেখছেন না তাঁরা। কিছু কৃষক বলছেন, লাভ তো দূরের কথা, এখন ঋণ আর সুদের টাকা তাঁরা পরিশোধ করতেই দিশেহারা। এ ছাড়া বাজারে ভুট্টা নিয়ে গেলে পাইকার ও তাঁদের দালালেরা ‘বাজারে এখন ভুট্টার দাম নেই’, ‘ভুট্টায় আর্দ্রতা নেই’ বা ‘ছত্রাক ধরেছে’ বলে দাম কমিয়ে দেন। এভাবেই প্রতিবছর স্থানীয় দালালদের কাছে ঠকছেন তাঁরা।


কয়েকজন কৃষক জানান, প্রতিবছর ভুট্টার মৌসুমে দালালের সহায়তায় কিছু পাইকার প্রতিটি এলাকায় ছোট–বড় অনেক গোডাউন তৈরি করেন। দালালের সহায়তায় নানা অজুহাতে কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ভুট্টা কেনেন। এতে ন্যায্যমূল্য পান না কৃষকেরা। ভুট্টার দাম কমে যাওয়ার কারণে কৃষকের হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অভাবের সংসারে টাকার প্রয়োজনে তাঁদের উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে দিতে হয়। এ ছাড়া জায়গার অভাবে উৎপাদিত ফসল সাধারণত কৃষকেরা নিজেদের ঘরে মজুতও করতে পারেন না। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এই ভুট্টা কিনে গোডাউনে রেখে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ব্যবসায়ীদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করেন। কয়েকজন কৃষক বলেন, করোনাভাইরাসে যদি সঠিক দাম না পান, তাহলে না খেয়ে থাকতে হবে তাঁদের।


সরেজমিন জানা গেছে, হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিঙ্গিমারী, ফকিরপাড়া ও বড়খাতা ইউনিয়নসহ তিস্তার চরা অঞ্চলে ১০টি গ্রামে অধিকাংশ খেতে কৃষকেরা ভুট্টার চাষ করেছেন। আর সামান্য কিছু খেতে বোরো ধানের বীজতলা গজাতে দেখা গেছে।
হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান ইউনিয়নের নিজ শেখ সুন্দর গ্রামের আনোয়ার হোসেন (৫০) বলেন, ‘ভুট্টা বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে গেলে স্থানীয় দালাল–ফড়িয়ারা বলেন, বাইরে পার্টি নাই, তাই ভুট্টার দাম নাই। তাই বাধ্য হয়ে প্রতিবছর ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায় প্রতি মণ ভুট্টা বিক্রি করতে হয়। টাকার প্রয়োজনে কম দামে ভুট্টা বিক্রি করতে বাধ্য হই। ভুট্টা বিক্রি করে তেল, শ্রমিক, সার, বীজ টাকা পরিশোধ করতে হয়। ব্যাংকের ঋণের টাকার কিস্তি দিতে হয়। এবারে করনাভাইরাস আসাতে দাম আরও কমে যাবে।’

ফসল ঘরে উঠলেও দাম পাবেন কি না, এটি নিয়ে চিন্তিত কৃষক। ছবি: প্রথম আলো
ফসল ঘরে উঠলেও দাম পাবেন কি না, এটি নিয়ে চিন্তিত কৃষক। ছবি: প্রথম আলো

আনোয়ার জানান, ‘যদি বাজার ব্যবস্থাপনা থাকত আর সরকার ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করে দিত, তাহলে আমাদের আর চিন্তা থকত না।’ বিষয়টি আমলে নিতে সরকারের প্রতি আবেদন জানান এই কৃষক।


সানিয়াজান ইউনিয়নের নতুন বাজার এলাকার ওসমান গনি (৩৫) বলেন, ‘স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী বাইরের ব্যবসায়ীদের ভুট্টা কিনতে বাধা দেন। আমরা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য বেশি দামে ভুট্টা বিক্রি করতে পারছি না। প্রতিবছর বাজারে এমন ঘটনা সৃষ্টি হয়। করোনাভাইরাসে এবার কী হয় বুঝতে পারছি না। ভুট্টা বিক্রি না হলে কী খেয়ে বাঁচব? আমাদের তাহলে না খেয়ে থাকতে হবে।’
হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের কৃষক আবদুস সালাম বলেন, ‘এবার ১০ বিঘা জমিতে ৭০০ টাকা কেজি দরে ভুট্টার বীজ কিনেছি। আশা করি, এবার বেশি দামে ভুট্টা বিক্রি করব। বাইরের ব্যবসায়ীরা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ভুট্টা কিনলে আমরা লাভবান হব।’
হাতীবান্ধা উপজেলার ফকিরপাড়া গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ বছর সার, বীজ, তেল, মজুরি দাম বেশি। জানি না ভালো দাম পাব কি না। এলাকায় ভুট্টার প্রচুর চাষ আবাদ হলে একসঙ্গে সব কৃষক ভুট্টা বাজারে নিলে বাজারে দাম কমে যায়। সরকার যদি ভুট্টার দাম নির্ধারণ করে দিত, তাহলে আমরা আরও লাভবান হতাম। তামাক চাষ না করে বেশি বেশি ভুট্টা চাষে মনোযোগী হতাম।’
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাহফুজুল হক বলেন, স্বল্প খরচে অধিক উৎপাদনকারী ফসল ভুট্টা। দেশে ভুট্টার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পুষ্টিগুণের পাশাপাশি পোলট্রি, ডেইরি ও ফিশফিড হিসেবেও এর চাহিদা প্রচুর। দেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে চার লাখ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হচ্ছে। আর উৎপাদন হচ্ছে ৩৮ লাখ মেট্রিক টনের বেশি ভুট্টা; যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার মাটি ও আবহাওয়া ভুট্টা চাষের জন্য উপযোগী। বারি এরই মধ্যে প্রোটিনসমৃদ্ধ ভুট্টা উদ্ভাবন করেছে, যা মানুষ ও পশু উভয়ের জন্য খুবই উপকারী। ভুট্টাদানা থেকে স্টার্চ, চিনি, সিরাপ, তেল এবং কাণ্ড, পাতা ও ডাঁটা থেকে কাগজ, কার্ড বা হার্ডবোর্ড, প্লাস্টিক পাইপসহ বহু শিল্পজাত দ্রব্য তৈরি করা যায়। এ ছাড়া দেশের মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত চাল ও গমের ওপর চাপ কমাতেও সরকার অধিক হারে ভুট্টা চাষের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
কৃষি বিভাগের তথ্য দপ্তর জানায়, কৃষক যাতে ভুট্টার ন্যায্যমূল্য পান, সে জন্য সরকার কাজ করছে। দেশে শষ্যগুদামে এগুলোর মজুতের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য রোধ করার জন্যও সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে জানায় কৃষি বিভাগ।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুসারে, ২০ থেকে ২১ অর্থবছরে ভুট্টা আমদানি হবে ২০ লাখ টন হবে। গত অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ টন। আগের অর্থবছরে আমদানি হয় ১৫ লাখ ২৪ হাজার টন।
কৃষি বিভাগের পরিচালক মো. আজহার আলী বলেন, ন্যায্যমূল্য দিয়ে কৃষকদের উৎসাহিত করা গেলে উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনি এই আমদানির হার কমে আসবে। এমনকি রপ্তানিও করা যাবে বলে মনে করে কৃষি বিভাগ। এবার করোনাভাইরাসে ভুট্টা কীভাবে কিনলে কৃষক ঠকবেন না, সেটি কৃষি বিভাগ চিন্তাভাবনা করছে বলে জানান তিনি। এ ছাড়া কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়া আর বাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নিয়ে সরকার কাজ করছে বলে জানান তিনি।