আকাঙ্ক্ষার অকালমৃত্যু

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ-বেদনার গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাস থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo. com

আমি অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ি। একদিন বিকেলে হঠাৎ মনে হয়, ভর্তি পরীক্ষার বিশাল যুদ্ধে জয়ী হওয়ার যেমন তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল, তেমনি একে তাড়াতাড়ি অতিক্রমের দ্বারা নতুন জীবনে প্রবেশের প্রয়াসও আমাকে উদ্‌গ্রীব করে তুলেছিল। ভর্তি পরীক্ষার যুদ্ধে জয়ী হয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রতিটি আনাচে–কানাচের স্বাদ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। নানা অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে ক্লাস শুরু হয় ১০ মার্চ। মহা আনন্দ আর উদ্দীপনা নিয়ে নতুন জীবনে প্রবেশের নানা মিছিলে নিজেকে জয়ী করে প্রথম অরিয়েন্টেশন ক্লাসে গেলাম। কে জানত হায়! নতুন জীবনে প্রবেশের সূচনা এখনো হয়নি। ক্যাম্পাস জীবনে প্রবেশের ছয় দিনের মাথায় এই আনন্দময় জীবনের ইতি ঘটাল করোনাভাইরাস। মহামারির বিশালতা পুরো রাজ্যজুড়ে করবে অবস্থান এবং আমরা যে হব নিতান্ত নিরুপায়, তা ভাবনাতেই ছিল না।

সকালে উঠেই খবরের কাগজে মৃত্যুর হারের গতিশীল দৃশ্য পড়ি। নাশতা খেয়ে বিছানায় মুঠোফোনের যত্রতত্র ব্যবহারের কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি এখন আমার হয় না। আম্মুও বকে না। দুপুরবেলার সংবাদে জানতে পারি সেই দিনের করোনার ছোবলে আক্রান্তের অবস্থা। নতুন দিনের সূচনা না হওয়ার সংশয়ে প্রতিটি দিন যেন কুরে খাচ্ছে আমাকে।

আমরা তিন বেলা খাবার খেয়ে বড্ড আরামে আছি। কিন্তু অসহায় মানুষগুলো এক বেলার খাবার কোথায় থেকে পাচ্ছে? তবে প্রশংসার বিষয়, অনেক মানুষ এই অসহায়দের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। যদিও তা নিতান্তই কম তাদের প্রয়োজনের তুলনায়।

বিকেলে ছাদে গিয়ে মুক্ত বাতাসের শ্বাস নিতে গেলেও মনে হয় আমি বুঝি আক্রান্ত হব। বাতাসে বাতাসে ভেসে এসে হয়তো আমার নিশ্বাসকে বন্ধ করে দেবে। আমার ও ছোট বোনের অ্যাজমার সমস্যা আছে। নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছি। মনে হয় এই বুঝি মৃত্যু এল, জেঁকে ধরল আমাদের। আবার ভাবি, পবিত্র রমজান মাসের রহমতের বর্ষণে আল্লাহ হয়তো এই দুর্যোগ থেকে আমাদের রেহাই দেবেন। আমরা হয়তো আবার ফিরে পাব প্রাণের স্পন্দন।
অন্ধকার রাতে তারকারাজির বিশাল আকাশ দেখে ভাবি, হয়তো নিস্তার মিলবে! আবারও এমন করে সাজবে আকাশ, দেখবে বিশ্ব।

দিন দিন বেড়েই চলেছে মৃত্যুর হার। দেশে নানা জিনিসের অভাব রয়েছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থানে রয়েছেন ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবকেরা। আমাদের হাসপাতালের অবস্থাও উন্নত নয়। সরকার একা কী করবে যদি না আমাদের বিবেক জাগ্রত হয়? সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতা করতে হবে। দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে গেলেও আমরা বাঙালিরা এখনো পিছিয়ে। কারণ, আমরা বাঙালিরাই এক একজন খ্যাতনামা চোর। এই মুমূর্ষু দিনেও চাল আত্মসাতের ঘটনার সূত্রপাত ঘটাতেও আমরা পিছপা হই না।

কত কী যে মনে হচ্ছে! ভাবছি, যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশ যখন মৃত্যুর হার হ্রাসে হিমশিম খাচ্ছে, আমাদের মতো ছোট্ট আয়তনের বিশাল জনবহুল দেশের অপরিষ্কার থাকতে অভ্যস্ত বাঙালিরা কীভাবে রেহাই পাবে এই দুর্যোগ থেকে? ভাবতে আর ভালো লাগে না। সময় যেন ফুরিয়ে আসছে।

তবে অন্যদিক দিয়ে চিন্তা করলে এই অফুরন্ত সময় এখন কেবলই পরিবারের কাছের মানুষগুলোর জন্য। দীর্ঘ সময় কাটাতে আমি কিছু চিত্রকর্ম করছি, যাতে প্রকৃতির অবাধ মেলামেশা রয়েছে এবং আনু মাহমুদের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বইটি পড়ছি। এখন এভাবেই সময়কে কাজে লাগাতে হবে, নইলে যে এরা আমায় ফাঁকি দেবে।

১৯ এপ্রিল বিকেলে আকাশে তাকিয়ে দেখলাম, ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে পাখিরা দল বেঁধে তাদের নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। মনে হলো, ঠিক এভাবে আমাদেরও উচিত চারদিকে করোনা মহামারি হওয়ার আগেই যেন আমরা সতর্ক হই।
তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার স্লোগানে মত্ত হয়ে যেন মানবিকতাকে বিসর্জন না দিই, তা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। করোনার ভয় যেন আমাদের মেরে না ফেলে।

কতই না ভাবনা ছিল! বন্ধুরা মিলে টারজানে আড্ডা দেব আর মনের সুখে গাইব কত গান! ৭০০ একরে ঘুরতে ঘুরতে একদম কাছাকাছি চলে যাব প্রকৃতির।

এখন ছোট্ট জানালা দিয়ে আকাশের বিশালতায় চাঁদ-সূর্যের উত্থান–পতনের দৃশ্য অবলোকন করি আর ভাবি ক্যাম্পাস জীবনে আনন্দের দেখা পাওয়া এখন শুধুই মরীচিকা। এখন আমরা সবাই স্তব্ধ।

তাই আমি আপন মনেই গাই...
করোনারে করে বিসর্জন
কবে যে পাব মুক্তি?
মৃত্যুর হাহাকারে...
বন্দী আমার অভিব্যক্তি।

*লেখক: শিক্ষার্থী রসায়ন বিভাগ