বিপদে বিআরটিসির শ্রমিকেরা

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

আইনটা হচ্ছে, নিজের আয় থেকে বেতন হবে। ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি, দুর্নীতি, অনিয়মের কারণে স্বাভাবিক সময়েই বিআরটিসির সব ডিপোতে সময়মতো বেতন হয় না। এবার লকডাউনের কারণে এক মাস ধরে বাস চলাচল বন্ধ। এ কারণে পেটে টান পড়েছে সরকারের পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির নিম্ন আয়ের কর্মীদের।
বিআরটিসির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সংস্থাটির ২১টি ডিপোর মধ্যে চার থেকে পাঁচটার আয় ভালো। বাকিগুলোতে আগে থেকেই ৩ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত বেতন বকেয়া পড়ে আছে। বকেয়া রেখেই চলতি মাসের বেতন দেওয়ার একটা চেষ্টা থাকে। কিন্তু লকডাউনের কারণে বাস বন্ধ থাকায় এখন চলতি মাস হোক আর বকেয়া—সব বেতনই আটকে গেছে। এর মধ্যে রোজা শুরু হয়েছে। এর আগে বৈশাখী ভাতা হয়নি। সামনে বেতন–বোনাস কোনোটারই নিশ্চয়তা নেই।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের প্রণোদনা চাইছে সংস্থাটি। ইতিমধ্যে ২০ কোটি টাকা আর্থিক প্রণোদনা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের সহায়তা না পেলে শ্রমিক–কর্মচারীদের ঈদ মাটি হয়ে যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিসির দুজন চালক বলেন, বাস চললে ইজারাদারের কাছ থেকে দিনে কিছু টাকা বাড়তি আয় করতে পারেন। বাস বন্ধ থাকায় সেটাও পাওয়া যাচ্ছে না। বেতনও বকেয়া। ফলে চালক, শ্রমিক ও টেকনিশিয়ানদের পেট চালানোই কঠিন হয় পেড়েছে।
বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. এহসানে এলাহী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সামনে কঠিন বিপদ। বাস–ট্রাক মিলিয়ে সারা দেশে তাঁদের ২৩টি ডিপো আছে। এর মধ্যে শুধু দুটি ট্রাক ডিপো চালু আছে। ৬০ শতাংশ ট্রাক মালামাল পরিবহন করছে। তবে এর আয় দিয়ে বড়জোর ৩০০ কর্মীর বেতন দেওয়া যাবে। সরকারি সহায়তা না পেলে প্রায় তিন হাজার কর্মীর বেতন দেওয়া সম্ভব হবে না। এ জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছেন।
বিআরটিসিসির অপারেশন শাখা সূত্র জানায়, সংস্থাটির তিন হাজার চালক, টেকনেশিয়ান, অফিস সহকারী ও নিরাপত্তারক্ষীর বেতন হয় ডিপোর আয় থেকে। তাঁরা মূলত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।
বিআরটিসিতে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৯০০ বাস সচল আছে। এগুলো প্রায় ২০০ রুটে চলাচল করে। সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের আনা–নেওয়ার কাজে বিআরটিসির বাস ব্যবহার করা হয়। এগুলোকে স্টাফ বাস বলা হয়। বার্ষিক চুক্তিতে এসব বাস চলাচল করে। এর বাইরে মালামাল ও পার্সেল পরিবহনে নিয়োজিত আছে ১১০টি ট্রাক।
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিআরটিসির নগর সেবার প্রায় সব বাস চলে ইজারার ভিত্তিতে। শাসক দলের নেতারাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব বাস পরিচালনা করেন। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, নামমাত্র মূল্যে এসব বাস পরিচালিত হচ্ছে। দূরপাল্লার পথে যেসব রুটে যাত্রীর চাহিদা বেশি, সেখানে বেসরকারি মালিকদের চাপে চালানো যায় না। ফলে সব সময় বিআরটিসি লোকসানি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া সংস্থাটির কর্মীদের দুর্নীতি এবং সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি তো আছেই। এ জন্য চালু থাকা অবস্থাতেই সরকারি সাহায্য ছাড়া চলা কঠিন। এখন বন্ধের সময় তো অনেক কর্মীকে না খেয়ে থাকতে হবে।
বিআরটিসির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সংস্থাটি মাসে ১২ কোটি টাকা আয় করে। এর মধ্যে ৫–৬ কোটি টাকা চলে যায় অবসরে যাওয়া কর্মীদের সুবিধা পরিশোধে এবং রক্ষণাবেক্ষণে। আর মাসে বেতন লাগে ৭ কোটি টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ আয়ের তুলনায় ব্যয় কিছুটা বেশি। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ৩৮ কোটি টাকার ঘাটতিতে আছে সংস্থাটি। এ জন্য কমবেশি ১৫টি ডিপোতে বেতন বকেয়া আছে। এর মধ্যে ঢাকার জোয়ারসাহারা ডিপোর ৮ মাসের বেতন বকেয়া আছে। এ অবস্থায় এপ্রিলের পর মে মাসেও বাস বন্ধ থাকলে লোকসানের পাল্লা ভারী হতে হতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এখন যেসব ডিপো নিয়মিত বেতন দেয়, সেগুলোও বেতন দিতে পারবে না।
জোয়ারসাহারা বাস ডিপোর শ্রমিক ও বিআরটিসির শ্রমিকনেতা আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তাঁদের বেতন বকেয়া পড়েছে। এ অবস্থায় আন্দোলন করে করে আট মাসের বেতন রেখে নভেম্বর থেকে বেতন পুনরায় (রানিং মাস) চালু হয়। ফেব্রুয়ারির বেতন মার্চের শেষ দিকে পেয়েছেন। এখন মার্চের বেতনের অপক্ষায়। কদিন ধরেই বলা হচ্ছে দেওয়া হবে। এখন এপ্রিল মাস শেষ পর্যায়ে। লকডাউনের কারণে শ্রমিক–কর্মচারীদের হাত পেতে চলতে হচ্ছে।
বিআরটিসি সূত্র জানায়, বিআরটিসিতে মাসে বেতন লাগে ৭ কোটি টাকার কিছু বেশি। কিন্তু আয় হয় গড়ে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। এক কোটি টাকার কাছাকাছি ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি ডিপোর বেতন বকেয়া পড়েছে ৮ থেকে ৯ মাস করে। বোনাস ও বৈশাখী ভাতাও আটকে আছে। সব মিলিয়ে এপ্রিলে ২১ কোটি টাকার মতো প্রয়োজন। কিন্তু বাস বন্ধ বলে আয় নেই। সম্পত্তির ভাড়া বাবদ ৫০ লাখ টাকার মতো আয় হয়। এ জন্য সরকারের কাছে ধরনা দিচ্ছে বিআরটিসি। সড়ক পরবিহন মন্ত্রণালয় কিংবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আর্থিক সহায়তা পেলে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া যাবে।

আইন অনুযায়ী, বিআরটিসির নিজস্ব কর্মীদের বেতন হয় নিজস্ব আয় থেকে। এ জন্য প্রতিটি ডিপোর আয় থেকে এর অধীনে কর্মীদের বেতন দেওয়া হয়।
বিআরটিসি সূত্র জানায়, ২২টির মধ্যে অর্ধেক ডিপোতেই সময়মতো বেতন হয় না। কোনো কোনো ডিপোতে আট মাস পর্যন্ত বেতন বকেয়া আছে। রাজধানীর নিকুঞ্জ এলাকার জোহারসাহারা ডিপো তাদের অন্যতম। এই ডিপোর কর্মীরা আট মাসের বেতন পাচ্ছেন না। যেসব ডিপোতে বেতন নিয়মিত হয়, সেগুলোরও এখন খারাপ অবস্থা। গত এক মাস বাস বন্ধ থাকায় চালু ডিপোগুলোরও বেতন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
মতিঝিলি ডিপোর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দুই মাসের বেতন বকেয়া ছিল। মার্চের ২১ ও ২৫ তারিখে দুই দফা বেতন দেওয়া হয়েছে। তবে এপ্রিলের বেতন দেওয়া কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে স্টাফ বাসের কিছু বকেয়া আছে, সেগুলো পেলে বেতন দেওয়া যাবে।
মতিঝিল ডিপোতে দিনে পাঁচ–ছয় লাখ টাকা আয় হয়। গত মার্চের ১৫ তারিখের পর থেকেই আয় কিছুটা কমতে থাকে। ২৬ মার্চ থেকে তো পুরোপুরি বন্ধ। এ সময় শুধু মতিঝিলি ডিপোই এক কোটি টাকার বেশি আয়বঞ্চিত হয়েছে। এই ডিপোর অধীনে মাসে বেতন দিতে হয় ৫০ লাখের বেশি। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে অনুদান ছাড়া বেতন দেওয়া কঠিন হবে।