দেশে ৯৯ শতাংশই আক্রান্ত হয় ছুটির ১ মাসে

দেশে সাধারণ ছুটি ও কার্যত লকডাউন (অবরুদ্ধ) পরিস্থিতির এক মাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৪ হাজার ৯৫৯ জন। সে হিসাবে মোট আক্রান্তের ৯৯ দশমিক ২১ শতাংশই আক্রান্ত হয়েছে ছুটির এই এক মাসে। এই সময়ে মারা গেছেন ১৩৬ জন, যা মোট মারা যাওয়াদের ৯৭ দশমিক ১৪ শতাংশ।

২৬ মার্চের আগ পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন মোট ৩৯ জন, মারা গিয়েছিলেন ৪ জন। তখন পর্যন্ত কয়েকটি জায়গায় সংক্রমণ সীমিত ছিল। সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। বন্ধ হয়ে যায় দূরপাল্লার সব ধরনের যান চলাচল, বেশির ভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকারখানা। আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার ‘লকডাউন’ না বললেও কার্যত পরিস্থিতি সে রকমই সৃষ্টি হয়।

আজ এ অবস্থার এক মাস পূর্ণ হচ্ছে। এখন দেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্ত ব্যক্তি ৪ হাজার ৯৯৮ জন। মারা গেছেন ১৪০ জন। সংক্রমণ ছড়িয়েছে দেশের ৬০টি জেলায়। এরই মধ্যে সাধারণ ছুটি বাড়ানো হয়েছে ৫ মে পর্যন্ত।

এর মধ্যেও প্রতিদিন সংক্রমণ বাড়ছে। এক জেলা থেকে আক্রান্ত রোগী অন্য জেলায় গিয়ে সংক্রমণ ছড়িয়েছেন সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরও। এরই মধ্যে দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন (জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হারে সংক্রমণ) শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে ছুটি ঘোষণাসহ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ কিছুটা হলেও উপকার দিয়েছে। এসব পদক্ষেপ না নিলে হয়তো সংক্রমণ আরও দ্রুত ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ত। জেলা পর্যায়ে লকডাউন (অবরুদ্ধ) পুরোপুরি কার্যকর করা গেলে সংক্রমণের গতি আরও ধীর করা যেত। লকডাউনের পরে বেশির ভাগ জায়গায় সংক্রমণ ছড়িয়েছে নারায়ণগঞ্জ থেকে যাওয়া ব্যক্তিদের মাধ্যমে।

দেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের খবর জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। প্রথম মৃত্যুর খবর জানানো হয় ১৮ মার্চ। এর মধ্যে সতর্কতা হিসেবে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব স্কুল–কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে শুরু হয় সাধারণ ছুটি। অবশ্য এর আগেই বিপুলসংখ্যক মানুষ রাজধানী ছেড়ে যায়।

ছুটি ঘোষণার পর সংক্রমণ ঠেকাতে মসজিদে জামায়াতে নামাজ আদায়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। জনসমাগম ঠেকাতে মাঠ প্রশাসন নানা উদ্যোগ নেয়। তারপরও বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে হাটবাজারে জনসমাগম অব্যাহত আছে।

শুরুতে সংক্রমণ শুধু বিদেশফেরত ও তাঁদের সংস্পর্শে আসাদের মধ্যে সীমিত ছিল। ২৬ মার্চের আগ পর্যন্ত আক্রান্ত ৩৯ জনের মধ্যে ১৪ জন ছিলেন ৮টি দেশ থেকে আসা। আর ২৩ জন বিদেশফেরত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাকি দুজন কীভাবে সংক্রমিত হয়েছিলেন, তা ছিল অজানা। ২৫ মার্চ আইইডিসিআর জানায়, তারা দুজনের সংক্রমণের উৎস খুঁজে পায়নি। ওই দিনই প্রতিষ্ঠানটি প্রথম জানায়, সীমিত পর্যায়ে লোকাল ট্রান্সমিশন (স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ) হয়ে থাকতে পারে বলে তারা ধারণা করছে।

৫ এপ্রিল রাজধানীর টোলারবাগ ও বাসাবো, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর (শিবচর) এবং গাইবান্ধা (সাদুল্যাপুর)—এই পাঁচটি জায়গাকে সংক্রমণের ক্লাস্টার (কাছাকাছি একই জায়গায় অনেক আক্রান্ত) হিসেবে চিহ্নিত করে আইইডিসিআর। সেখান থেকে সংক্রমণ ছড়ানো ঠেকাতে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানানো হয়। এই পাঁচটি জায়গার চারটিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলেও নিয়ন্ত্রণের পুরোপুরি বাইরে চলে যায় নারায়ণগঞ্জ। রাজধানীতেও ব্যাপকভাবে সংক্রমণ ছড়ায়।

নারায়ণগঞ্জ থেকে সংক্রমণ ছড়ানো ঠেকাতে ৭ এপ্রিল এই জেলা পুরোপুরি লকডাউন ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই জেলার ভেতরে রোগী বাড়ার পাশাপাশি লকডাউন ফাঁকি দিয়ে আক্রান্ত অনেকে ছড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন জেলায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বুলেটিনেও জানানো হয়, অনেক জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়েছে নারায়ণগঞ্জ থেকে। ১০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জকে সংক্রমণ ছড়ানোর কেন্দ্রস্থল (এপিসেন্টার) হিসেবে চিহ্নিত করে আইইডিসিআর। গতকাল পর্যন্ত এই জেলায় রোগী শনাক্ত হয়েছে ৫৯৪ জন।

৫ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের ১১টি জেলায় রোগী শনাক্ত হয়। ৯ এপ্রিল থেকে বেশি সংখ্যায় রোগী বাড়তে শুরু করেছে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা জানান, ৬০টি জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়েছে। গতকাল পর্যন্ত রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরা জেলা সংক্রমণমুক্ত ছিল।

দেশে সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হয়েছে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা। এখন পর্যন্ত দেশের মোট রোগীর অর্ধেকের বেশি (৫১ দশমিক ৫১ শতাংশ) রাজধানীর। আর মোট রোগীর ৮৫ শতাংশই ঢাকা বিভাগে।

আইইডিসিআরের পরামর্শক ও রোগতত্ত্ববিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মহামারি একেবারে রুখে দেওয়া যায় না। বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে এটার বিস্তারের গতি ধীর করা যায়। এতে প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে একটু আগেভাগেই সাধারণ ছুটির পাশাপাশি সব বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ কারণে সংক্রমণ একটু ধীর হয়েছে। তাঁর মতে, এই ছুটিতে যদি সবকিছু আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেত, তাহলে সংক্রমণের গতি আরও ধীর হয়ে যেত। যেটুকু সময় পাওয়া গেছে তাতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে কি না, তা নিয়ে অনেকের প্রশ্ন আছে। প্রস্তুতি আরও ভালো হতে পারত।