করোনায় সাদিয়ার পরিবারের গল্প

গাড়ি চালিয়ে নিজেই অসহায় পরিবারের মধ্যে খাবার পৌঁছে দেন সাদিয়া। ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া
গাড়ি চালিয়ে নিজেই অসহায় পরিবারের মধ্যে খাবার পৌঁছে দেন সাদিয়া। ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া

করোনাভাইরাসের বিস্তারে মানুষ দিশেহারা। কাজকর্ম বন্ধ। যে পরিবারগুলো মানুষের কাছে হাত পেতে খাওয়ার কথা চিন্তাও করেনি, এমন অনেক পরিবারও এখন সাহায্যের জন্য হাত পাততে বাধ্য হচ্ছে। সংযোগ বাংলাদেশ নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত সাদিয়া নাসরিন, তাঁর ব্যবসায়ী স্বামী সাদ আহমেদ শামীম আর কিশোর বয়সী তিন ছেলেমেয়ে নিজেদের যেটুকু সামর্থ্য আছে, তা নিয়েই করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। পরে এই পারিবারিক উদ্যোগে বন্ধু, স্বজন অনেকেই এগিয়ে এসেছেন।

সাদিয়া বলেন, ‘আমার হাজব্যান্ড বাজার করে দেওয়া থেকে শুরু করে বলতে গেলে পুরো কার্যক্রমে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছেন। বাজার বাসায় আসার পর বাচ্চাদের নিয়ে আমি প্যাকেট করতাম। তারপর নিজে গাড়ি চালিয়ে রাজধানীর এ–মাথা থেকে ও–মাথা—যে যেখান থেকে খাবার চেয়েছেন, পৌঁছে দিয়েছি। ২১০টি পরিবারের পাশে থেকেছে আমার পরিবার। এর বাইরে ৫০টি পরিবারের ৩ মাসের খাবারের দায়িত্ব নিয়েছে আমার পরিবার। আর শুরুটা হয়েছিল আমার ঈদের শাড়ি আর বাচ্চাদের সাইকেল কেনার টাকা দিয়ে। পরে আর থামতে পারিনি।’

সাদিয়া বলেন, ‘আমরা এই সহায়তা দান বা জাকাতের টাকায় দিইনি। বাচ্চারা বাসায় দৈনন্দিন কাজ করে যে হাত খরচ পেত, তা দিয়েছে। আমাদের আগামী ৩ মাসের সঞ্চয় পরিকল্পনা বাতিল করেছি। ঈদ বা রোজায় বাড়তি যে খরচ করতাম, তা–ও বাতিল করেছি।’

সাদিয়া জানিয়েছেন, তাঁর পরিবার, বন্ধু ও স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া সহায়তায় এখন পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মোট ৫১০টি পরিবারের সংকট বিবেচনায় তাদের মধ্যে ১ মাস, ১৫ দিন বা ৭ দিনের প্রয়োজনীয় খাবার ও সুরক্ষাসামগ্রী পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। এ পারিবারিক উদ্যোগে বাইরের অনেকেই আর্থিক সহায়তা দিয়ে পাশে রয়েছেন। আবার অনেকেই সমালোচনা বা কটাক্ষও করেছেন। আসলেই কাজ হচ্ছে কি না, তা নিয়ে অনেকে সন্দেহও প্রকাশ করেছেন। সহায়তা করতে গিয়ে সাদিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা প্রথম গুরুত্ব দেন সেই আত্মীয়, পরিজন, সহকর্মীদের, যাঁদের আয় স্বল্প, সঞ্চয় করার সুযোগ নেই এবং কারও কাছে মুখ ফুটে সাহায্য চাইতে পারছেন না। সাদিয়া জানালেন, সন্তানদের স্কুলের বাচ্চাদের বিভিন্ন পরিবার এবং নিম্ন আয়ের কর্মহীন মানুষেরাও এ সহায়তা পাওয়ার তালিকায় ছিলেন।

সাদিয়া বলেন, পারিবারিক উদ্যোগের পাশাপাশি তিনি তাঁর ব্যক্তিগত টাকা দিয়ে করোনা–যুদ্ধ মোকাবিলায় যাঁরা সরাসরি কোভিড–১৯ রোগী নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের উপহার দিয়েছেন ফেসশিল্ড, যা সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করা জরুরি।

সাদিয়া জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা ইউনিটে যাঁরা স্যাম্পল কালেকশন করেন, তাঁদের জন্য ২০০, সাদিয়ার নিজের জেলা কক্সবাজারের কোভিড হাসপাতালে ১৫০, উখিয়ায় নির্মাণাধীন কোভিড হাসপাতালে ১০০, মৃতদেহ সৎকারের জন্য আল মারকাজুল ইসলামীকে ৫০টিসহ মোট ৮০০ ফেসশিল্ড উপহার দেবেন। ইতিমধ্যে ৬০০টি বিতরণ করে ফেলেছেন তিনি।

সাদিয়া জানিয়েছেন, চিকিৎসকদের খাবার দেওয়ার ভাবনার কথা ফেসবুকে লিখলে করোনা–যোদ্ধাদের সমন্বয়ক পর্যায়ের একজন ফেসশিল্ড দেওয়ার পরামর্শ দেন। চিকিৎসকদের সংগঠনের একজন মুখপাত্রও একই পরামর্শ দিয়েছিলেন। সাদিয়া বললেন, কেউই প্রয়োজনের বাইরে একটা জিনিসও বেশি নেননি বা চাননি।

সাদিয়া সন্তানদের এগিয়ে আসা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার মেয়ে সুবাইতা মারসাদ তার ছোট দুই ভাইকে পড়িয়ে মাসে পাঁচ হাজার টাকা টিউশন ফি পায়। প্রতি মাসের সাত তারিখ ওর বেতন বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এটা তার নিজের রোজগার। ওখান থেকে প্রতিমাসে তার স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্টে বাধ্যতামূলক জমা দিতে হয় তিন হাজার টাকা। বাকিটা তার হাতখরচ। ছেলে সাফওয়ান আমীম প্রতিবার গাড়ি পরিষ্কার করে পায় ১০০ টাকা, মাসে ১৫ বার করলে ১ হাজার ৫০০ টাকা। আমার ছবি তুলে ভালো ছবি প্রতি ২০ টাকা নেয়। আমাকে আইটি সাপোর্ট দেয়, তার সার্ভিস চার্জ পায় গড়ে এক হাজার টাকা। তার স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্টে জমা দিতে হয় দুই হাজার টাকা। মাহাথির যামীম গাছে পানি দেয়। প্রতিবার ৫০ টাকা। মাসে কমবেশি ১ হাজার ৫০০ টাকা রোজগার। ওরও স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্ট আছে, ওখানে জমা দিতে হয় এক হাজার টাকা। প্রত্যেকের একজন সুবিধাবঞ্চিত শিশুর পড়ার খরচ স্পন্সর করতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে। প্রতি ঈদে ওদের স্পন্সরে শিশুকে নতুন জামা আর খাবার কিনে দিতে হয়। একেবারে ছোটবেলা থেকেই এই নিয়ম।’

খাদ্যসামগ্রী প্যাকেট করছে সাদিয়ার ছেলে। ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া
খাদ্যসামগ্রী প্যাকেট করছে সাদিয়ার ছেলে। ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া

সাদিয়া বলেন, ‘করোনাভাইরাসের বিস্তারে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ছেলেমেয়েরা তাদের নিজেদের রোজগারের টাকা দিয়েছে। গত দুই মাস তারা একটাবার বাইরের খাবার খায়নি, খাবার নিয়ে বায়না করেনি, বাড়তি পয়সা খরচ করেনি। বাচ্চারা নিজেরাই বলেছে, এই বছর যেহেতু ঈদের কেনাকাটার প্রশ্ন নেই, ঈদের খরচ পুরোটাই বেঁচে যাবে। আগামী দুই মাসেও বাইরে খেতে বা ঘুরতে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সেই খরচও হবে না। ইফতারেও খরচ কমবে। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ, ফলে হাতখরচও লাগেনি। ওদের যা ছিল, তা নিয়েই করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি।’

সাদিয়া জানিয়েছেন, প্যারিসে থাকা তাঁর বন্ধু ফ্রেডরিক এবং তাঁর মা সীমান্ত, দৈনিক ‘ইত্তেফাক’–এর সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, আইনজীবী রাশিদা চৌধুরী, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরাসহ বিভিন্ন জন যে সহায়তা দিয়েছেন, তা দিয়ে বেশি পরিবারের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছে।

করোনাভাইরাসে সৃষ্ট যে পরিস্থিতি, তাতে হাত পেতে সাহায্য নেওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

অনেকে মেসেঞ্জারে বাচ্চার দুধ কেনার টাকা চাচ্ছেন। রিকশাচালকেরা বাড়ির গেটে এসে বলছেন, ঘরে খাবার নেই। কিন্তু কতজনকে দেওয়া সম্ভব? তাই অতৃপ্তি নিয়েই সাদিয়ার বক্তব্য, ‘তবুও থামতে হয়। শক্তি, সামর্থ্য, সাহস, শরীর, মন সব রিফুয়েলিং করার জন্য একটু দম নিতে হয়। তবে আমার বা আমার পরিবার সামর্থ্য অনুযায়ী কার্যক্রমটা চালু রাখতে চাই।’