করোনা মোকাবিলা জোরালো করার তাগিদ জনস্বাস্থ্যবিদদের

করোনাভাইরাস সংক্রমণ আছে কি না, তা পরীক্ষা করাতে এসেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্যরা। বিকেল নাগাদ পরীক্ষা করা হবে জেনে তাঁরা হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে পুলিশের গাড়িতে অপেক্ষা করছেন। রাজধানীর হাইকোর্টসংলগ্ন এলাকায় সাধারণত দায়িত্ব পালন করে থাকেন বলে জানান তাঁরা। গতকাল বেলা তিনটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের সড়কে।  ছবি: আশরাফুল আলম
করোনাভাইরাস সংক্রমণ আছে কি না, তা পরীক্ষা করাতে এসেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্যরা। বিকেল নাগাদ পরীক্ষা করা হবে জেনে তাঁরা হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে পুলিশের গাড়িতে অপেক্ষা করছেন। রাজধানীর হাইকোর্টসংলগ্ন এলাকায় সাধারণত দায়িত্ব পালন করে থাকেন বলে জানান তাঁরা। গতকাল বেলা তিনটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের সড়কে। ছবি: আশরাফুল আলম
>পরিস্থিতি মোকাবিলায় রোগের পরীক্ষা, হাসপাতালের শয্যা প্রস্তুতসহ সব উদ্যোগ প্রয়োজমতো নেওয়া জরুরি।

দেশে কত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন, তার একটি অনুমিত সংখ্যা সরকার পেয়েছে। এই প্রাক্কলনের সঙ্গে জড়িত জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় রোগের পরীক্ষা, হাসপাতালের শয্যা প্রস্তুতসহ সব উদ্যোগ প্রয়োজনমতো নেওয়া জরুরি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও করোনা-পরবর্তী পরিকল্পনা (এক্সিট প্ল্যান) তৈরির কাজ করছে। তবে সংক্রমণ পরিস্থিতির বর্তমান পর্যায়ে তৈরি পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র ধীরে ধীরে সচল করার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে কত মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন, কত মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা আছে, দেশের হাসপাতালগুলো রোগীর চাপ সামাল দিতে পারবে কি না-দেশের মানুষের মনে এ রকম বহু প্রশ্ন রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৪৮ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষের সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। রক্ষণশীল হিসাবে, ৩১ মে পর্যন্ত ৪৮-৫০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। মৃত্যুর আশঙ্কা আছে ৮০০ থেকে এক হাজার মানুষের। আর পরিস্থিতি যদি সবচেয়ে খারাপ হয় তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ছুঁতে পারে। ২১ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ এই অনুমিত সংখ্যা দিয়েছিলেন।

সূত্র বলছে, এই প্রক্ষেপণ বা প্রজেকশন তৈরি করেছে আটজন বিশেষজ্ঞের একটি দল। তাঁরা তাঁদের বিদেশি বন্ধুদের সহায়তা নিয়েছেন। দেশের আটটি বিভাগের করোনা কার্যক্রমে উপদেষ্টা হিসেবে এই আটজনকে গত মাসে নিয়োজিত করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত সপ্তাহে তাঁদের দেওয়া অনুমিত সংখ্যাই আবুল কালাম আজাদ আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে উপস্থাপন করেছিলেন। বিশেষজ্ঞ দলটি গতকাল মঙ্গলবার সকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও সিলেট বিভাগের উপদেষ্টা আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন দেশে এর বিস্তারের ধরন, আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার, জনমিতি, আবহাওয়া, সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের নেওয়া উদ্যোগ-এ রকম আরও বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছি এবং পরিস্থিতি কোথায় যেতে পারে, সে কথা বলেছি।’

প্রস্তুতির ঘাটতি
গত চার মাসে গণমাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খবর জানার পর সাধারণ মানুষের ধারণা জন্মেছে যে বাংলাদেশে বহু মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। এ দেশে জনঘনত্ব বেশি, মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা কম-এমন বিষয়গুলো তারা কারণ হিসেবে দেখেছে।

তবে আক্রান্তের অনুমতি সংখ্যা যা-ই হোক, সাধারণ মানুষ ও বিশেষজ্ঞ সবাই মনে করে প্রস্তুতির ঘাটতি আছে। রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষাও কম হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘আমরা বলেছি, দিনে কমপক্ষে ১০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করতে হবে।’

দেশে এখন ২৫টি ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা হয়েছে গত সোমবার, ৪ হাজার ৩৩২টি। পরীক্ষার সমন্বয়ের দায়িত্বে আছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। তিনি সোমবার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, পাঁচ দিনের মধ্যে আরও পাঁচটি নতুন ল্যাব পরীক্ষা শুরু করবে। আগামী মাসের শুরুতে দৈনিক পাঁচ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হবে।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোবলেছেন, ল্যাবের সংখ্যা বাড়িয়ে ৫০টি করার চিন্তাভাবনা চলছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সংক্রমিত ব্যক্তিদের ১৫ শতাংশের মারাত্মক সংক্রমণ থাকে, ৫ শতাংশের পরিস্থিতি থাকে জটিল। এই ২০ শতাংশকে অবশ্যই হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। ২১ এপ্রিলের সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও একই কথা বলেছিলেন।

পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হলে অর্থাৎ এক লাখ মানুষ আক্রান্ত হলে ২০ হাজার মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। সে ক্ষেত্রে হাসপাতালে ২০ হাজার শয্যার প্রস্তুতি দরকার। কিন্তু সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেই প্রস্তুতিতে ঘাটতি রয়েছে। গত সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, রাজধানীর ৯টি সরকারি ও ৬টি বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৩ হাজার ৯৪৪টি শয্যার প্রস্তুতি আছে। এর মধ্যে আছে কুর্মিটোলা, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী ও মুগদা হাসপাতালের ১ হাজার ২০০ শয্যার হিসাব রয়েছে। যদিও এসব হাসপাতালের শয্যা অর্ধেকের কিছুটা বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।

রাজধানী ছাড়া আট বিভাগে ৬৪টি হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এসব হাসপাতালে মোট শয্যা আছে ৫ হাজার ৭৯৪টি। অর্থাৎ রাজধানীসহ সারা দেশে করোনা চিকিৎসায় এখন শয্যা আছে ৯ হাজার ৭৩৮টি।

এ ছাড়া রাজধানীর মহাখালীতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একটি মার্কেট ও বসুন্ধরা গ্রুপের একটি সম্মেলনকেন্দ্রকে হাসপাতাল হিসেবে তৈরি করার কথা বলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসব জায়গায় জটিল রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে না। এসব হাসপাতাল তৈরি হলেও খুব বেশি দিনের জন্য কাজে লাগবে না। তখন এই বিপুলসংখ্যক শয্যা, আসবাব, যন্ত্রপাতির কী হবে, তারও পরিষ্কার ধারণা কারও নেই।

নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) সুবিধার স্বল্পতাও রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, জটিল ৫ শতাংশ রোগীর আইসিইউ দরকার হতে পারে। দেশে ৫ হাজার আইসিইউ শয্যা দরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, করোনা রোগীদের জন্য রাজধানীসহ সারা দেশে আইসিইউর শয্যা আছে মাত্র ৩৪১টি।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলছেন, ‘এখন পর্যন্ত যত শয্যা আছে, তত রোগী হয়নি। একসঙ্গে সব রোগী হাসপাতালে থাকবে না। আশা করি, পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারব।’

সমন্বয়ের ঘাটতি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বলে আসছে, করোনা মোকাবিলা করা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার কাজ না। এর সঙ্গে সরকারের আরও অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে যুক্ত হতে হবে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। করোনা বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে এমন একটি দাতা সংস্থার প্রতিনিধি প্রথম আলোকে বলেন, সব মন্ত্রণালয় সমান গুরুত্ব দিয়ে করোনা মোকাবিলায় যুক্ত হয়নি। তিনি বলেন, ল্যাব-সংকটের কারণে পরীক্ষা বেশি হচ্ছে না। কিন্তু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও প্রতিষ্ঠানে করোনা পরীক্ষার জন্য ৩৫টি পিসিআর যন্ত্র পড়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনটি যন্ত্র আছে।

অন্যদিকে আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার প্রকল্পে শতাধিক প্রশিক্ষিত টেকনোলজিস্ট আছেন। তাঁদের নমুনা সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করার সুযোগ আছে। কিন্তু তাঁরা কাজ করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে।

ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক করোনা মোকাবিলার কাজে অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। দাতাদের সূত্র বলছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে প্রকল্প চূড়ান্ত করে টাকা খরচ শুরু করতে পারেননি কর্মকর্তারা। করোনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ব্যাপক কর্মকাণ্ড হাতে নিলেও মন্ত্রণালয় বাড়তি কোনো বরাদ্দ এখনো দেয়নি।

সূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
সূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

শেষ কোথায়
জনস্বাস্থ্যবিদদের ধারণা, মে মাসের শেষের দিক থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া শুরু হতে পারে। তখন পরীক্ষায় রোগী শনাক্ত কম হবে। হাসপাতালে রোগী কম ভর্তি হবে। তখন সরকারের কৌশল কী হবে, সেটা একটা বড়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা) ইকবাল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেমন, লকডাউন (অবরুদ্ধ করা) পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু একসঙ্গে একটি বিভাগের নাকি একসঙ্গে কয়েকটি জেলার তুলে নিলে ভালো হবে, এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, পরীক্ষা ও রোগী শনাক্ত এবং চিকিৎসা অব্যাহত রাখতে হবে। করোনা হাসপাতালগুলো শুধু করোনার কাজে জুনের শেষ পর্যন্ত ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। এসব বিবেচনায় রেখে আস্তে আস্তে পর্যায়ক্রমে লকডাউন (অবরুদ্ধ) তুলে নিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেছেন, ‘আমরা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ পেয়েছি। চীনসহ অন্য দেশের বিষয়গুলোও দেখব। আলোচনা-পর্যালোচনা করে সরকারকে পরামর্শ দেব। “আমরা এক্সিট”প্ল্যান নিয়ে কাজ করছি।’

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের তথ্য প্রকাশ করে সরকার। গত ৫০ দিনে মোট রোগী শনাক্ত হয়েছে ৬ হাজার ৪৬২। এ সময়ে গতকাল এক দিনে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয়েছে ৫৪৯ জন। সংক্রমণের এই পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধ কতটা শিথিল করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, কলকারখানা চালু করা দরকার ঠিকই, কিন্তু তা করা দরকার নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। সন্দেহভাজন কারখানায় শতভাগ শ্রমিকের পরীক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। চিকিৎসার পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে আগামী দিনের পরিকল্পনা করতে হবে।